প্রথমার্ধে থাকে না-হয়ে ওঠার কাহিনী।আর এই কাহিনীর পাতায়-পাতায় থাকে উপেক্ষা, বঞ্চনা, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ, অবহেলা আর পিছন থেকে টেনে ধরে সামনে এগোনোর পথে বাধা দেওয়ার একটা লম্বা সময়ের ইতিহাস। জীবনের ওঠা-পড়ার বহু ক্ষেত্রে এমন ঘটনা হরদম দেখতে পাওয়া গেলেও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা সরাসরি আঘাত করে প্রতিভার উন্মোচনে। প্রতিভার পরিচয়-ই তো সৃষ্টিশীল কাজে, উদ্ভাবনী শক্তিতে। সেক্ষেত্রে প্রতিভাকে-ই যদি নিরন্তর আঘাত-উপেক্ষা করা হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয় সমাজ, উত্তরাধিকার।
যে এলাকায়, যে জনপদে গুণের কদর থাকেনা, সেখানে গুণীর পরিবর্তে সমাজপতির চারপাশে থিকথিক করে স্তাবকের ভীড়। অনেক সময় একটা সমাজের মাতব্বররা এক বা একাধিক মানুষের তাৎক্ষণিক চাতুর্য্য ও উপস্থিত বুদ্ধিকে প্রতিভা রুপে আখ্যায়িত করেন। এতে শিল্প -সাহিত্যের প্রতিভা যুগপৎ ব্যাথিত ও বিস্মিত হয়। কারণ কোন প্রভাবশালী নিজের চারপাশে একটা স্তাবক-পরিমন্ডল গঠনের উদ্দেশ্যে কাউকে কবি বা সাহিত্যিক রুপে ঘোষণা করলেই তিনি ‘তা’ হয়ে ওঠেন না। শিল্পী, শিল্পী-হয়ে ওঠেন মানুষের ভালোবাসায়।
প্রকৃত শিল্পী কখনোই কারো স্তাবকতা করতে পারেন না। তিনি স্বভাবে বিনয়ী কিন্তু অন্তরে জেদি, অহংকারী, মাথা নত করতে না চাওয়া অনড় মনোভাবী। কেননা তিনি ‘শিল্প’ ছাড়া আর কাউকে পরোয়া করেন না। শিল্পী কাউকে তোয়াজ করে চলতে শেখেন নি, কেননা ‘স্তাবকতা’ কিম্বা তোষামোদী’ শব্দ দুটো তাঁর অভিধানে নেই। শিল্পী নিজেকে শুধুমাত্র বাঁচিয়ে বা টিকিয়ে রাখার জন্য আপোষ করে চলতে রাজী নন।
শিল্পী বাঁধাধরা নিয়ম মানেন না। তাই তাঁর সৃষ্টিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাঁকে নিরন্তর এক একক-লড়াইয়ের যাত্রা করতে হয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘ সাহিত্যের কোন শর্ত নেই’ প্রবন্ধে বাঁধাধরা নিয়মনীতি কিম্বা তোয়াজের তাৎক্ষণিক সুবিধা’কে সাহিত্যে মানতে চাননি। জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘ একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতায় একটি মোমের মতন জ্বলে ওঠে হৃদয় এবং ধীরে ধীরে কবিতা-জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায়’।
সহজ, তরল ও চটুলের মোহে যখন সমাজ ক্রমশ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়বে তখন বিশুদ্ধ শিল্প-সাহিত্যের চর্চার পথ কখনোই বাধামুক্ত হতে পারেনা। যদি একটা সমাজে প্রতিভাধর কিম্বা শ্লাঘনীয় মানুষের অভাব ক্রমশ বাড়তে থাকে তাহলে সমাজের কতটা সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সম্ভব! যদি একটা সমাজ বা জাতি কোন প্রতিভাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে না পারে তাহলে সেই সমাজের মানসিক স্বাস্থ্য কি সবল হয়!
কিন্তু প্রকৃত শিল্পী, যথার্থ প্রতিভাধর কি এসব কথা ভেবে শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি থেকে দূরত্ব রাখেন? না। তিনি দুঃখ পান, তিনি কষ্ট পান। কিন্তু শেষমেষ সকল বিদ্রূপ উপেক্ষা করে তিনি তাঁর সৃষ্টিতে মগ্ন হয়ে থাকেন। বোধহয় এই উপেক্ষিত শিল্পীদের জন্যই তিনি লিখেছেন, যিনি বিখ্যাত অভিজাত-ধনী পরিবারে জন্মেও লক্ষ-কোটি সমালোচনা সহ্য করতে করতে বিশ্বকবি হয়েছেন, সেই রবীন্দ্রনাথের লেখায় ——–
‘ যে তোরে পাগল বলে
তারে তুই বলিস নে কিছু।
আজকে তোরে কেমন ভেবে
অঙ্গে যে তোর ধুলো দেবে
কাল সে প্রাতে মালা হাতে
আসবে রে তোর পিছু-পিছু’ ————