ছড়ামণি নতুন ছড়ার সম্ভার – তৈমুর খান.
শিশুসাহিত্যিক মিহির পালের ‘ছড়ামণি'(প্রথম প্রকাশ ২০২০) ৪৯টি নতুন ছড়ার সম্ভার। দীর্ঘদিন ছড়া নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন তিনি। এই গ্রন্থটি সেই পরীক্ষারই চূড়ান্ত নির্মাণ বলা যায়। ছড়া মূলত বর্ণনাত্মক কবিতা। ছন্দই সেখানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলা ছন্দের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যে মাত্রা গণনা পদ্ধতি এবং অন্ত্যমিলের ধারা তাতে ছড়ায় স্বরবৃত্তই একমাত্র ছন্দ। মিহির পাল এই ধারার মধ্যে থেকেও এক নতুন পথের সন্ধান করেছেন। প্রতিটি ছড়াতেই তিনি যে অতিপর্বের ব্যবহার করেছেন তাতে সম্মুখ মিলের মধ্যেও মাত্রা গণনায় সামঞ্জস্য এনেছেন। আবার এই অতিপর্বগুলি যেমন ক্রিয়াপদে, সর্বনামে, বিশেষ্যপদে অথবা অব্যয়পদে নির্মিত হয়েছে। খুব সচেতনভাবেই বুদ্ধিদীপ্ত এই কাজটি করেছেন। হয়তো নতুনরা তাঁর কাছ থেকেই প্রেরণা পাবেন। দু একটি উদাহরণ নিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়:
“উঠলো রবি পুব আকাশে
ছুটলো ঘোড়া সবুজ ঘাসে।
ফুটলো কুসুম ভোরের বেলা
জুটলো অলি সুখের মেলা।”
উল্লেখ্য উঠলো ছুটলো ফুটলো জুটলো সবগুলিই ক্রিয়াপদ এবং সবগুলি সম্যক স্বর। শ্বাসাঘাত এর ফলে তারা যেমন স্বরবৃত্ত তেমনি দু মাত্রার অতিপর্ব বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। পুরো কবিতাটিতেই এভাবে নিখুঁত নির্মাণ চোখে পড়ে।
আর একটি ছড়ায় লক্ষ করা যায় সম্মুখ স্বরের অতিপর্বটি বিশেষ্য:
“চাঁদ উঠেছিল গগনে
ফাঁদ দেখলো দুই নয়নে।
বাদ সাধল কানাই-বলাই
সাধ মিটাতে মালা গলায়।
ছাদ বেয়ে নামলো পরী
বাঁধ ভেঙে সমান করি।”
চাঁদ ফাঁদ বাদ সাদ ছাদ বাঁধ প্রভৃতি শব্দগুলির মাত্রাও একই।
কোনো কোনো ছড়ায় অতি পর্বটির মাত্রা গণনা একই রেখেও পদগুলির মধ্যে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বিশেষ্য বিশেষণ ক্রিয়া অব্যয় সর্বনাম মিশ্রভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এরকমই একটি ছড়া:
“ছড়ি হাতে স্যার ঘোরে
ঘড়ি দেখে রয় দোরে।
হরি কাকা দেয় ঘন্টা
দেরি করে আসে মন্টা।
চড়ি গাছে আম খেতে
ভরি ব্যাগে নেবো সাথে।”
ছড়ি ঘড়ি হরি দেরি চড়ি ভরি প্রভৃতি শব্দগুলির মধ্যে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে, কিন্তু মাত্রায় কোথাও গড়মিল নেই।
এরকম একটি ছড়ার বই সত্যিই বিরল। শুধু শিশুদেরই নয়, বড়দের কাছেও বিষয়টি নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। বাংলা সাহিত্যে কবি মিহির পালের এই কাজ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জীবনের নানা অনুষঙ্গ, প্রকৃতি, ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন এবং আমাদের চারিপাশের পরিজনদের কথা ছড়াগুলির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি। প্রচ্ছদ এবং বাঁধাই আকর্ষণীয়। যে কোনো শ্রেণির পাঠককেই আকৃষ্ট করবে।
ছড়ামণি: মিহির পাল, সহযাত্রী প্রকাশনী, ৮ পটুয়াটোলা লেন, কলকাতা-৯, মূল্য:১৩০ টাকা। প্রচ্ছদ শিল্পী: মামণি পাল।