–
–
শেষ বিকেলের আলো ক্রমশঃ নিভে আসছে. পাশের বাড়িতে দীনেশ বাবুর রেডিওতে হেমন্তর গান বাজছে -যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই——.
গানটা শুনে মানসের মনটা ভারাক্রান্ত হলো. সত্যিই তো. অনেক দিন তো হলো এই পৃথিবীতে আসা. কত কিছু দেখা হলো, শোনা হলো. শেখা হলো তার থেকে বেশী. কত হিসেব নিকেশ বাকীও রয়ে গেলো. সকলেরই তাই থাকে.
সত্তর অতিক্রান্ত দীনেশ বাবুর এক ছেলে, দুই মেয়ে. নাতি -নাতনিরাও যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে.
পেনশন আর প্রাইভেট পড়িয়ে দীনেশ বাবুর দিব্যি চলে যায়. স্ত্রী বিজয়া বরাবরই অহংকারী.তাঁর রূপের দেমাকও আছে. প্রথম যখন এপাড়ায় ওঁরা এসেছিলেন তখন অনেকেই তা লক্ষ্য করেছিল.তাঁর আবৃত্তি করারও সখ আছে.
তারপর, নানা ঘাতপ্রতিঘাতে, দেখতে দেখতে কেটে গেছে বহু বছর.
দীনেশ বাবু বরাবরই মানুষ ভালো কিন্তু স্ত্রীকে সমীহ করে চলেন . একটু আত্ম প্রচারও পছন্দ করেন. বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর পড়াশোনাও আছে. মনের মানুষ পেলে গল্প করতে ভালোবাসেন.
এই দীনেশবাবুই গত সপ্তাহে করোনা আবহে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন. বাড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ানোয় পাড়ায় রটে গেলো তাঁর করোনা হয়েছে. বাড়িতে কাজের লোক আসা বন্ধ হলো. প্রতিবেশীরাও দূরত্ব বজায় রেখে আড়চোখে সব জরিপ করতে লাগলো.
এদিকে নিকট প্রতিবেশী মানসের কাছে নানা পরিচিত জনের ফোন আসতে লাগলো-
‘পজিটিভ না নেগেটিভ? আসলে ওরা চেপে যাচ্ছে. এই থানার গাড়ী, হেলথ কেয়ার টীম এলো বলে. ‘
—-এবার সকলকেই কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে. টি. ভি তে চ্যানেলে চ্যানেলে বিশেষজ্ঞরা অনবরত বলে চলেছেন, -ষাট পার হলেই ঝুঁকি. যাদের সুগার, প্রেসার, হার্ট -এর দোষ আছে তাঁদের আর আশা নেই—-
এসব সালতামামি আর প্রতিবেশীদের ঘেটো সমালোচনা শুনে মানস বিব্রত হয়ে পড়লো. একটা অজানা আতঙ্ক তাকেও গ্রাস করতে লাগলো. তারও যে ষাট পেরিয়ে গেছে. হেমন্তের সেই গানটা বড় কানে বাজতে লাগলো.
নিতান্তই উদ্বিগ্ন হয়ে মানসের স্ত্রী অনুভা দুদিন পর দীনেশ বাবুর ছেলে অজয়কে মোবাইলে ধরে জানতে পারলো, হ্যাঁ উনার একটা চেস্ট ইনফেকশন আছে. তবে শ্বাসকষ্ট অনেকটা কমেএসেছে. হাসপাতাল সুপার তার অনুরোধে করোনা টেস্ট করবেন বলেছেন.
খবরটা শুনে মানস একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো.
যাক বাঁচা গেল! আমাদের তাহলে আর কোয়ারেন্টাইনে যেতে হচ্ছে না—-
এর পর প্রায় কয়েক সপ্তাহ নানান মন্তব্য ও গবেষণায় কেটে গেলো. কাজের লোক কাজে ফিরলো. কিন্তু উৎসুক প্রতিবেশীদের একটা সন্দেহ থেকেই গেলো. দীনেশ বাবু গেলেন কোথায়? তাহলে কী —
এদিকে মানসের সেই বেলা শেষের গানটাই বার বার কানে বাজতে লাগলো. জীবন ও সমাজ সম্পর্কে এই বয়সে একটা উপলব্ধি হলো, মানুষ সত্যিই স্বার্থপর. মনে পড়লো এক দার্শনিকের স্মরণীয় উক্তি, ‘Man is selfish by nature’.সত্যিই, আমরা কারও মঙ্গল কামনা না করতে পারলেও অমঙ্গলটা মনের অজান্তেই চেয়ে থাকি.
এর ঠিক এক সপ্তাহ পর এক সকালে একটা প্রাইভেট গাড়ী দীনেশ বাবুর বাড়ীর সামনে এসে থামলো. প্রতিবেশীদের জানলা, দরজাগুলি সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেলো. বাড়ীর ভেতর থেকে একটা কান্নার আওয়াজও যেন শোনা গেলো.
মানস অস্থির হয়ে মুখে মাস্কটা লাগিয়ে দ্ৰুত বাড়ী থেকে বেরিয়ে দেখলো -দীনেশ বাবু গাড়ী থেকে নিজেই নামছেন. মানস হেসে স্বাগতম জানালো.
দীনেশ বাবু স্ত্রীর আনন্দাশ্রু মুছিয়ে দিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমার করোনা টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ.’
উৎসাহী প্রতিবেশীরা মাথা নীচু করে যে যার বাড়ী ফিরে গেলো.