–
—
(১)
ভোর পাঁচটা বাজে ঘড়িতে,অলসতার চাদর সরিয়ে উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে। পৌষ মাস পড়া থেকে এই প্রথমবার বেশ জমিয়ে ঠান্ডা পড়লো। এইসময় গ্রামের দিকে বেড়াতে যেতে খুব ভালো লাগে, আমার এক দূরসম্পর্কের বোনের বাড়ি গ্রামে….আগের বাড়ে যখন গেছিলাম পিঠেপুলি-পাটিসাপটা-মনোহরা গুড় সব খায়িয়েওছিলো,আবার দিয়েও দিয়েছিল।
একটু বাদেই সকাল হবে, তখন বাজারে যাবো যদি মাছ-টাচ কিছু পাই। কুয়াশার মোটা পর্দায় ঘিরে আছে, এখনো অন্ধকার কাটেনি। উঠে কম্বলের তলাতেই বসে থাকলাম কিছুক্ষন আসলে বয়স হয়েছে তো;একটু এদিকওদিক হলেই ঠান্ডা লেগে যায়।
কিছুক্ষন বসে থেকে, উঠে গিয়ে আলমারি থেকে পুরোনো অ্যালবামটা বার করে আনলাম। গিন্নি তো ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে,ওর আবার ঘুমোলে সার থাকেনা ঘুমের ওষুধ খায় তো।
সারাদিন ছোট্ট পাখির মতো টুকটুক করে ঘুরে ঘুরে কাজ করে, আর খিট খিট করে বেড়ায়। কিন্তু ও যখন ঘুমিয়ে পরে তখন কি মিষ্টি লাগে মুখটা। মনে হয় বাচ্চা মেয়ে।
মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পরই ছেলে চাকরি সূত্রে দেশের বাইরে চলে গেল। এখন আমরা দুজন একা থাকি।
মাঝে মাঝে নাতি নাতনি আসে, দুটো কথা বলবো তার উপায় নেই, এসে থেকেই ফোন নিয়ে কুটকুট করবে।
ইচ্ছে করে, আবার সেই পঞ্চাশ বছর আগে যদি ফিরে যেতাম,তাহলে খুব ভালো হতো। যখন আমি কলেজে পড়তাম, সেই বন্ধুরা…সেই খোলা মাঠ…সেই ফুটবল ম্যাচ…আর..আর,শ্রিতমা….আমার চোখের তারায় যার বাস ছিল। যার প্রেমে রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছি। তখন তো এত facebook ও ছিল না আর whatsapp ও ছিল না। কিন্তু ভালোবাসা ছিল…প্রেম ছিল ,শুধু একবার ওর মুখটা দেখবো বলে,ঘন্টার পর ঘন্টা ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ওর হাবভাব দেখে সবাই ভাবতো যে,আমাদের মধ্যে কিছু একটা সম্পর্ক রয়েছে।
সেদিন ছিল আমাদের কলেজ ফুটবল ম্যাচ….
আমাদের কলেজের সাথে আরেকটি কলেজের। একদিকে ফুটবল ম্যাচ আর অন্যদিকে ওকে মনের কথা বলার ইচ্ছা।
(২)
দুর্দান্ত একটা ম্যাচ;কিন্তু খেলার মাঝখানে বার বার চোখ যাচ্ছে মাঠের কোন থাকা শিমুল গাছটার দিকে…মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে আছে শ্রিতমা। ম্যাচ শেষ হতে অনেক দেরি, এদিকে ম্যাচ ছেড়ে যেতে পারছিনা আর অন্য দিকে মনটা শ্রিতমা কাছে পরে আছে। যাইহোক ম্যাচ যখন শেষ হলো, আমি তাড়াতাড়ি করে শিমুল গাছের দিকে যেতে গিয়ে দেখি শ্রিতমা সেখানে নেই। তারপর থেকে কলেজে ওকে দেখতে পাইনি,খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম ওর বিয়ে হয়ে গেছে। বড্ডো কষ্ট হয়েছিল সেদিন, রাতে কিচ্ছুটি খাইনি, শুয়ে পড়েছিলাম।
স্বপ্নের মধ্যে বারবার শ্রিতমা কে দেখতে পাচ্ছিলাম…ও যেমন করে ডাকতো দীপুদা ও দীপুদা সেই স্বরটাও শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার জ্বর এসেগিয়েছিলো।
কথাটা ভাবলেও বুকের ভেতর হুহু করে ওঠে,
কিন্তু এই ৭২ বছর বয়সে হাসি পাচ্ছে।
তারপর মধ্যিখানে কেটে গিয়েছিল দ-ুতিন বছর। পড়াশুনা শেষ করলাম।
(৩)
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘড়ির দিকে তাকালাম দেখলাম ঘড়ির কাটা ৬ এর ঘর ছুঁই ছুঁই,আসলে মাছ ছাড়া গিন্নি ভাত খেতে পারেনা। তাই বাজারে যাওয়ার এত তাড়া। গিন্নি বলতে মনে পড়লো, পড়াশুনা শেষ করে,একটি পত্রিকার অফিসে কাজে ঢুকলাম। এইবার বাড়ি থেকে সমন্ধ করতে লাগলো। মা একটার পর একটা ছবি দেখাচ্ছে কিন্তু মনেই ধরছে না কাউকে,ছবি দেখলেই কেমন যেন মনের ভেতর মুছড়ে উঠছে। এমন সময় উত্তর কলকাতার এক বনেদি পরিবারে আমার সমন্ধ করে, মেয়েটির বয়স ১৮ কি ১৯ হবে। একটা ছবি আমার মা আমায় দিলো, আমি না দেখেই বইয়ের মধ্যে রেখে দিলাম। আর অন্যদিকে,মেয়েটির বাড়ির লোকেরা সব ব্যবসাদার মানুষ,তাদের চাকরিওয়ালা জামাই পছন্দ নয়।
এইভাবে সমন্ধ ভেঙে গেল।তিন-চার মাস পর আমার এক বন্ধুর বিয়েতে গেছি,সেখানে হঠাৎ চোখ পড়ে একটি মেয়ের উপর, সদ্য যৌবনা…খুব যে সুন্দরী তা নয়,তবে তার উপস্তিতি যেন চারিদিক আলো করে রেখেছে। আমার বন্ধু বললো, ও আমার শ্যালিকার ছোট ননদ, বনেদি বাড়ির মেয়ে। কিছুতেই বিয়ে হচ্ছে না জানিস বড্ডো রোগা বলে, কিছুক্ষন এর জন্যে হলেও ওকে দেখে আমি শ্রিতমা কে ভুলে গিয়েছিলাম।বাড়ি এসে, মাকে বললাম তুমি সমন্ধ করো আমি ওই মেয়েকেই বিয়ে করবো। মা খানিক অবাক হলেও শেষে রাজি হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হলো ওরা কিছুতেই রাজি হলো না। ও যেখানে গান শিখতে যায় সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, ও বেরোচ্ছে দেখে ওর সাথে কথা বলতে গেলাম, সে কথা না বলেই চুপচাপ মুখ নিচু করে চলে গেল এই ভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর,একদিন ও নিজে থেকেই আমার সাথে কথা বলতে এলো…ও জানালো যে ওদের বাড়ি থেকে আপনাকে কখনোই মেনে নেবে না,কারণ ওরা ব্যবসাদার লোক চাকরি করা পছন্দ করে না। আমি ওকে সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি আমায় পছন্দ করেন? ও চুপ করে থেকে বললো,আমার নাম প্রমীলা। আপনি তো পত্রিকা অফিসে চাকরি করেন তাই না?বৌদিদি বলছিলেন।
আমি আবার বললাম,আমি প্রশ্নের উত্তর পাইনি এখনো,
প্রমীলা, বললো সব প্রশ্নের উত্তর কি দিতে হয়? কিছু বুঝে নিতে হয়।
যাক সে সব কথা,এরপরের দিন আপনি আসবেন তো আমি কিন্তু অপেক্ষা করবো।
আমি হেসে বললাম হ্যাঁ আসবো।
এর পরের দিন, আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা চলে গেছিলাম রাস্তা ধরে। কত কথা বলার ছিল, আর কত কথা শোনার ছিল….সব শুনলাম….কিন্তু আরো কথা বলতে ইচ্ছে হলো, চেয়েছিলাম সেদিন সময় তা যেন ওখানেই থমকে যায়।
পরের দিন, দেখি ম্যাডাম এর মন খারাপ। বাড়ি থেকে একটি ছেলে দেখা হয়েছে,ব্যবসাদার উত্তর কলকাতাতেই বাড়ি,বড় শাড়ির দোকান। আমি জিজ্ঞাসা করলাম তোমার কি ইচ্ছা? ও বললো, এই বিয়েটা যদি বন্ধ করা যেত ভালো হতো। আমি বললাম বিয়ে করবে আমায়? ওর মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম তবুও ওকে বললাম, তুমি যা চাইবে তাই হবে, তুমি যদি না চাও তাহলে…তার আগেই আমায় থামিয়ে দিয়ে বললো আমি বিয়ে করতে রাজি।
তারপর আমরা বিয়ে করলাম, আর আমাদের প্রথম হনিমুন ছিল ওই দূরসম্পর্কের বোনের বাড়ি। অনেক বছর ওদের বাড়ির লোকেরা আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখেনি। তারপর….
তারপর আর কি….কেটে গেল অনেক বছর….এখনো প্রমীলার সাথে দেখা হওয়ার কথা মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। স্মৃতির গলি বেয়ে যখন হেঁটে যাই তখন মনে হয় অনেক ভালো খারাপ সময় গেছে…কিন্তু স্মৃতির পাতায় শুধু ভালোবাসাই থেকে গেছে। ৬ টা বাজে, বাজারের ব্যাগটা নিয়ে রাস্তায় বেড়ালাম, যাওয়ার পথে শিবুর দোকানে চা খাবো। তারপর দেখবো বাজারে কি মাছ এসেছে।
“আলো আর ঔজ্জ্বল্য চিরগর্বিত স্বল্পভাষী,
কষ্ট জড়ানো অন্ধকারকে চিরকাল ভালোবাসি”
–
–