বলল, “তোমার পড়া নেই ?”
ঘ্যাঙরচাঁদ একবার ঘ্যাঙর-ঘঁক শব্দে ঢোক গিলে বলল, “আজ তো রবিবার।”
মাষ্টারমশাই হাতের বেতখানা নাচিয়ে বললেন, “পড়াতে এলেই দিন খন বার তিথি মনে আসে, তাইনা ? কই খাওয়ার সময়, খেলার সময় ওসব কথা তো মনে আসে না ! চলো চলো, আজ ঐক্যতাণের ক্লাস আছে। সেটা শেষ হলেই সাঁতারের ক্লাস।”
নিরুপায় হয়ে চলে গেল ঘ্যাঙরচাঁদ, যাবার সময় বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল সে। খুব কষ্ট হলেও কিছু বলতে পারল না কিটকিট। হাজার হোক ভবিষ্যতের প্রশ্ন। ঘরে তো সে দিদিকেই দেখেছে সারাক্ষণ মোবাইল আর টিভি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। আর পরীক্ষায়…..? লবডঙ্কা।
ঘ্যাঙরচাঁদের প্রাসাদ হতে বেরিয়েই পাথুরে রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল কিটকিট। কিছুটা গিয়েই দেখল একটা পানাপুকুরে কতগুলো ব্যাঙ বসে বসে ঐক্যতাণ করছে। সামনে ছড়িহাতে ওদের মাষ্টার।
এরই মাঝে একটা মোটাসোটা ব্যাঙ এসে বলল, “বাছারা, আজ টিফিনে কি খাবে ?”
একদল গলাচড়িয়ে বলল,- “খিরররর্…. রুটি…… খিরররর্… রটি…..”
আরেকদল প্রতিবাদ করে বলল, “পোলাপ…. পোলাপ……”
এই নিয়ে দুদলে ঝগড়া বেধে গেল। মাষ্টারমশাই তখন বেত হাতে ঝাপিয়ে পড়লেন জলে। ব্যাঙের ছানারা মারের ভয়ে যে যেদিকে পারে মারল দৌড়। কিটকিট হাসতে হাসতে রওনা দিল নিজের গন্তব্যের দিকে।
– হাবল আর ক্যাবল-
কিছুটা হাঁটতে পা অবসন্ন হয়ে এল। তাছাড়া জাদুকরের ঘর যে কতটা উত্তরে তাও তো জানা হয়নি। কঙ্কাবতীর পাওয়ার যে এত সমস্যা তা কিটকিট জানত না। সে দিনরাত খেতো দেতো আর খাটের নিচে বসে থাকত। পাড়ার কোনও বিড়ালও বলবে না যে সে কিটকিটকে দেখেছে।
এরকম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই একটা বড় জলাশয়ের কাছে এসে হাজির হল কিটকিট । জলাশয়ের স্বচ্ছ কাকচক্ষু জল। সেই জল দেখেই তৃষ্ণা জাগে। জলটল খেয়ে জলাশয়ের ধারে একটা ঝোপের ভেতর বসে একঘুম দিয়ে নিলে মন্দ হয় না। কিটকিট চলল জল খেতে।
জলাশয়ের ঘাটটা বেশ সুন্দর। মিহি বালির সেই ঘাটে একটা বড় ডিমের মতো পাথর। তবে পাথরটার উপরিতল চ্যাটালো। সেই পাথরের পাশে দাঁড়িয়ে দুটো গাধা ‘ঘ্যাকো ঘ্যাকো’ শব্দে নিজেদের মধ্যে কি যেন আলোচনা করছে। কিটকিট যেতেই ওরা পথ আটকে বলল, “জল খাবে পরে, এখন আমাদের সমস্যার সমাধান কর।”
-“কি সমস্যা তোমাদের ?” শুধাল কিটকিট ।
কপালে সাদা লোম থাকা গাধাটি বলল, “আমার নাম হাবল, আর এ হল ক্যাবল। আমরা দুই ভাই। কাছেই মাঠে চরছিলাম। তৃষ্ণা পেতেই এখানে এসেছি, কিন্তু জল খেতে পারছি না। কেন বল তো ?”
কিটকিট পড়ল মহা মুশকিলে। গাধাদুটো কেন জল খেতে পারছে না সে জানবে কিভাবে। অনেক ভেবচিন্তে বলল, “নিশ্চয়ই জলটা খারাপ। বাজে স্বাদ এর। ”
হাবল আর ক্যাবল ঘ্যাকো ঘ্যাকো করে হেসে উঠে বলল,”ভুল ভুল, এক্কেবারে ভুল। আমরা জলে মুখই দিইনি।”
কিটকিট রেগে গিয়ে বলল,”তোমারা গাধা তাই খাওনি। এত সুন্দর জল না খাওয়ার কি আছে। আমি বাপু না খেয়ে থাকতে পারছি না।”
এই বলে গাধাদুটোর সব বাধা অতিক্রম করে চোঁ চোঁ শব্দে পেট ভরে জল খেল কিটকিট। তারপর পাথরটায় বসে পড়ল নিশ্চিন্তে। বিকেলের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে গায়ে । ঘুম আসছে আধবোজা চোখে বলল,”একটু ঘুমিয়ে নিই, তারপর তোমাদের উত্তরের কথা ভেবে দেখা যাবে।”
কিটকিট ঘুমিয়ে পড়ল। গাধাদুটো উত্তরের আশায় বসে রইল তাকে ঘিরে। এদিকে সূয্যিমামা অস্ত যাচ্ছেন। তার বিদায় বেলার লালচে আলো জলের পড়ে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। চারদিকের ঝোপঝাড় হতে ঝিল্লিরা জেগে উঠেছে। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের আসন্ন জলসার। পুকুরের পাড়ের আমগাছের কোটর হতে প্যাঁচাবউ উকি মারছে। সে দেখছে অন্ধকার হল কিনা, অন্ধকার হলেই বের হবে শিকারের সন্ধানে।
কোটরে বসে প্যাঁচাকর্তা বলছে, “আহ্, ঘুমোও তো একটুখান। না ঘুমোচ্ছ নিজে আর না ঘুমোতে দিচ্ছ আমাদের।”
প্যাঁচাবউ রাগত স্বরে বলছে, “ঘরে বসে খেলে এমনই হয়। তোমার আর কি ! যত দায় তো আমার। বলি সকাল সকাল ইঁদুরটি ব্যাঙটি ধরে না এনে দিলে খাবে কি ? না খেয়ে মরবে যে ! যত কুঁড়ে আমার কপালে জুটেছে !!!”
প্যাঁচার তীক্ষ্ণ ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল কিটকিটের। চোখ খুলে দেখল রাত হয়ে এসেছে। হাবল আর ক্যাবল ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে। সামনের পা’দুটো প্রসারিত করে আটা আড়মোড়া ভেঙ্গে নিয়ে পাথরটা হতে লাফ দিল কিটকিট। কিন্তু একটুর জন্য লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়ল জলে। পা চারটে ভিজে গেল। আর জলটা ঘোলা হয়ে উঠল। ঘোলা জল দেখে গাধাদুটোর সে কি আনন্দ ! তারা ঘ্যাকো ঘ্যাকো আওয়াজ করে জল খেতে শুরু করল। প্রয়োজন মতো পা দিয়ে জল ঘোলা করে নিতে লাগল।
গাধাদের এসব কান্ডকারখানা দেখে বাবার কথা মনে পড়ে গেল। বাবা বরাবরই দিদিকে বলতেন-‘গাধা জল ঘোলা করে খায়।” দিদি শুনে রেগে গেলেও এই কথাটা যে ধ্রুব সত্যি তা বুঝতে পেরেছে কিটকিট।
জলখাওয়া শেষ হতেই হাবল বলল,”তুমি চললে কোথায় ভাই ?”
কিটকিট বলল,”আমি চললাম উত্তরের পথে। ওখানে এক জাদুকর আছে, সেই জাদুকর জানে রাজকুমারী কঙ্কাবতীর সন্ধান।”
ক্যাবল আশ্চর্য হয়ে বলল,”সে তো অনেক পথ। চলো তোমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি। রাতেরবেলা রাস্তা ভালো নয়। পদে পদে বিপদ। আমাদের সঙ্গে চলো।”
গাধা হলেও অন্তরে মায়া মমতা আছে এদের। হাবল বসে পড়ল। এরপর ধীর পায়ে এগিয়ে হাবলের পিঠে চেপে বসল কিটকিট। হাবল আর ক্যাবল দুজনেই দৌড়তে শুরু করল। সে কি দৌড় ! ঝোপঝাড় ডিঙ্গিয়ে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দৌড়ে যেতে লাগল ওরা।
রাস্তায় কি যে পড়ছে সে দিকে দৃষ্টি নেই কারোর। বন্ধুকে পৌঁছে দেওয়াটাই আসল। তাই কখনো কাঁটাঝোপের মধ্য দিয়ে তো কখনো কাদার উপর দিয়ে অক্লেশে দৌড়তে লাগল ওরা ।
কাঁটাঝোপের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় সারা শরীরে কাঁটাফুটে একেক্কার হয়ে গেল। যন্ত্রণাকাতর গলায় কিটকিট বলল, “দেখে তো চলো।”
সে শুনে হাবল বলল, “গাধার আবার দেখেশুনে চলা ! সঠিকভাবে দেখেশুনে চললে গাধাদের অপমান হয়। আমরা যত বেয়াড়ার মতো চলি তত আমাদের সুনাম। আমাদের কি বেয়াড়া দেখছ, আমার দাদু ছিল আমাদের কুলের সবচেয়ে বড় বেয়াড়া। একবার তো একটা মাছির পেছনে ছুটে গিয়ে পড়েছিল ময়রার মিষ্টির গামলাতে। কিন্তু একটুর জন্য ‘গাধাশ্রেষ্ঠ’ হতে পারলেন না। ”
আফসোসের ভঙ্গি করল হাবল। কেবলও দাদার কথায় সায় দিয়ে মুখটা চুকচুক করল। বললাম,”গাধাশ্রেষ্ঠ হতে পারল না কেন ?”
হাবল বলল,”মিষ্টির রসটা ঠান্ডা ছিল। ওটা গরম থাকলেই দাদুকে আটকাতে পারত না কেউ। কিন্তু কিই বা করার, যা হবার তা তো হবেই।”
চলবে…..