সকালে অ্যালার্ম বাজলেই সীমার ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে যায়। মেয়ের টিফিন করে দিয়ে স্কুল পাঠানোর ব্যবস্থা করা। বর সমর ব্যাঙ্কে কাজ করে, সাড়ে নটার মধ্যে অফিসে ঢুকতে হয় তাকে রেঁধে বেড়ে খাইয়ে পাঠানো।
তারপর রেডি হয়ে নিজে স্কুল যাওয়ার জন্য নটা পঁয়ত্রিশের লোকাল ধরে। বেশীর ভাগ দিনই গুঞ্জা ওর জায়গা রেখে দেয়। ও কোনমতে গিয়ে ট্রেন ধরে, জায়গাটা গুঞ্জার কল্যানে পেয়ে যায় রোজ। এই হুড়োযুদ্ধির মধ্যে ওর একটা বাতিক তৈরী হয়েছে, সবসময় মনে হয় বাড়ির গ্যাসটা ঠিকমতো বন্ধ করা হল কিনা। এই নিয়ে সমর হাটের মাঝখানে হাসিঠাট্টাও করে।
এই তো সপ্তাহ খানেক আগে রিক্সায় চেপে পাঁচমিনিটের পথ পার করে মনে হল গ্যাসটা অফ করা হয় নি রিক্সা ঘুরিয়ে গ্যাস অফ আছে কিনা দেখে আবার যখন বেরোয় তখন সে পুরো কুড়ি মিনিট লেটে চলছে। গুঞ্জা বেচারী একাই রওনা দিয়েছিল, সেদিন সীমা দেরীতে স্কুল ঢোকার জন্য খেয়েছিল বড়দির ঝার। ওর এই বাতিকটা সবাই না জানলেও কেউ কেউ জানে, তারা চোখ চাওয়াচায়ি করে।
আর একবার অনেক পরিকল্পনা করে সবাই মিলে দীঘা যাবে ঠিক হল, শেষ মুহূর্ত্তে কিছু রান্নার প্রয়োজনে গ্যাস জ্বালিয়েছিল সীমা, অন্যান্য কাজ সেরে যখন গুছিয়ে গাছিয়ে দরজা বন্ধ করে রওনা হল তখনও প্রায় সব ঠিকঠাক। গন্ডগোল বাঁধল স্টেশনে পৌঁছে, সীমার মনে হতে লাগল সে গ্যাসের সুইচ অফ করে নি। ওর টেনশনে শেষ অব্দি সবাই বাড়ি ফিরতে বাধ্য হল।
এবারে কিন্তু সবাইকে অবাক করে তনিমার কথাই সত্যি প্রমাণিত হল, গ্যাস খোলা, গোটা ঘরে গ্যাসের গন্ধ। যখন জানলা, দরজা খুলে সিলিন্ডার থেকে বের হওয়া গ্যাসকে ঘরের থেকে বার করা হল তখন তো ট্রেনের সময় পার হয়ে গেছে। পরিকল্পনা করেও বেড়াতে যাওয়া বাতিল হয়ে গেল। এতে সীমার আত্মবিশ্বাসে আরও চিড় ধরল, ওর বাতিক ক্রমশ উর্ধমুখী হল।
আজ আবার সীমার জন্মদিন, সকাল থেকে সবাই ফোন করছে, তারই মাঝে ওকে কাজ সারতে হচ্ছে। প্রিয় বান্ধবী গুঞ্জাও ফোন করেছিল। ছুটি নেওয়ার উপায় নেই, স্কুলে পরীক্ষা চলছে।
অগত্যা দ্রুত হাতে কাজ সারছে। কোনমতে তৈরী হয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে সীমা ভাবল, “অটো ধরে নি, তাড়াতাড়ি স্টেশন পৌঁছে যাব।” স্টেশনের প্রায় কাছে এসে মনে হল, খাবার গরম করে গ্যাস অফ করা হয় নি। দোটানা নিয়ে না এগিয়ে ফিরতি অটোয় বাড়ি ফিরে দেখে সব ঠিকঠাকই আছে। ফোন বাজছে, ওকে দেখতে না পেয়ে গুঞ্জা ফোন করেছে।
ওকে নটা পঁয়ত্রিশের লোকালে চলে যেতে বলে স্টেশনের পথ ধরে সীমা। স্টেশনে এসে দেখে লোকে লোকারণ্য, কোনরকমে ঠেলে ঠুলে জায়গা করে ভেতরে ঢুকে দেখে প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছুটা ছাড়িয়ে তাদের রোজকার যাওয়ার পথে অগুন্তি মাথা, জিজ্ঞেস করে জানতে পারে এক্সপ্রেস একটা ট্রেন সিগন্যালিংয়ের গন্ডগোলে নটা পঁয়ত্রিশের লোকালটাকে ধাক্কা মারায় অনেকেই গুরুতর আহত।
ছুটতে ছুটতে ওদের রোজকার কামরার সামনে গিয়ে দেখে রেলপুলিশ গুঞ্জার ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে বার করার চেষ্টা করছে। সীমা উদভ্রান্তের মতো কাছে গিয়ে দেখে দেহে প্রাণ নেই।
কান্না ডুকরে আসে, সীমার বাতিক সীমাকে বাঁচিয়েছে, নাহলে লাশের স্তূপে সীমার নামও যোগ হোত। সেই থেকে সীমার বাতিক বিষয়ে কেউ আর মজা করে না, বরং প্রসঙ্গটা উঠলেই সবার চোখ জলে চিক চিক করে।
আপনার মতামত এর জন্য