নৈষ্ঠিক আকাডেমি প্রকাশ করেছে স্বল্পায়ু সুজিত অধিকারীর(১৯৭৫-২০১৪) দুটি কাব্য ‘ভালোবাসার মুখ শ্লেটে আঁকা ছবি নয়'(২০২০) এবং ‘শ্রীমতীর ভাঙন রোধে'(২০২০)। সুজিতের বহু পাণ্ডুলিপি যা এতদিন দৃষ্টির অগোচরে ছিল ক্রমশ তা সংগ্রহ করে নৈষ্ঠিক আকাডেমি যে কাজটি করে চলেছে তা খুবই প্রশংসার যোগ্য। সুজিত অধিকারীর কী বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল বাংলা সাহিত্যের পাঠক জানে না। যে সময় তিনি তার বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে সকলের সামনে উদিত হবেন সেই সময়েই তাঁর অকস্মাৎ পতন ঘটে। এক নির্মম নিয়তির পরিহাস। আমরা তাঁর কবিতায় যতটুকু পরিচয় পাই তাতেই তাঁকে একজন বিরল প্রতিভার অধিকারী বলেই মনে হয়েছে।
পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে কবিতারও প্রয়োজন আছে যখন সুজিত অধিকারীর কবিতা পড়ি তখনই তা মনে হয়। ‘প্রেমের বৃষ্টি এনে মৃত্যু ধুয়ে দাও’ এমন অমোঘ উচ্চারণের কাছে মাথা নুয়ে আসে। কেননা কবিতা শুধু শব্দের ঝনাৎকার নয়। হৃদয়ের সংরাগে বেদনার বিভূতি হয়ে তা শব্দে শব্দে রূপ ধারণ করে। কবিতা কি সবাই লিখতে পারে? না, প্রকৃত কবিতা সবাই লিখতে পারে না। যে হৃদয় উপলব্ধির ব্যাপ্তি নিয়ে সূক্ষ্ম জীবনবোধের অন্তর্দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারে, সে-ই দেখতে পায় অব্যক্ত আর্তনাদ কতখানি আত্মক্ষরণের মর্মন্তুদ পিপাসায় কাতরায়। সুজিত যখন লেখেন:
“সাদা পৃষ্ঠায় ভেসে ওঠে তার চোখ ও হৃদয়
তাকে পাঠাই পত্রপত্রিকার ঠিকানায়
কখনো কখনো এক কোণে বসে থাকে কবিতা
যেন মায়ের মুখাগ্নি করে সদ্য ফিরে এলো সন্তান”
এখানে সেই কবিতার কথাই বলেছেন কবি যে কবিতা জীবন্ত। মানবিক ইন্দ্রিয় সম্পন্ন। বোধে ও মেধায়, উপলব্ধিতে ও নীরবতায় বাঙ্ময় উপস্থিতি জানান দেয়। তাই তার চোখ ও হৃদয় যেমন আছে, তেমনি মায়ের মুখাগ্নি করা সন্তানের মতো শোকার্ত বেদনার্ত অভিমুখও আছে। আছে নিঃসঙ্গতায় নীরব হওয়ার পরিচয়। কবিতার এই বহুমুখী প্রাজ্ঞসন্দর্শন প্রতিটি শব্দে শব্দে স্পন্দিত হয়। সার্বিয়ান কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ব্যবসায়ী এবং প্রাক্তন সাংবাদিক দেজান স্টোজানোভিচ (Дејан Стојановић জন্ম: ১১ মার্চ, ১৯৫৯) তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায় লিখেছেন:
“Since there is no real silence,
Silence will contain all the sounds,
All the words, all the languages,
All knowledge, all memory.”
অর্থাৎ যে নীরবতার আমরা খোঁজ করি সেই প্রকৃত নীরবতা কি আছে? যার মধ্যে থাকবে সমস্ত ধ্বনি, সমস্ত শব্দ, সমস্ত ভাষা, সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত স্মৃতি। এই নীরবতাই বোধের মহিমাকে ব্যঞ্জিত করেছে সুজিত অধিকারীর কবিতায়। তিনি আরও সুন্দর করে তা প্রকাশ করেছেন:
“একটি শব্দের প্রয়োজনে কত রাত জেগেছি
দেখেছি মানস-প্রতিমা
কালের সীমানা ভেঙে ছুটে যায় স্তব্ধ তীরে”
সেই স্তব্ধতার অন্বেষণই কবিতার মূল ভিত্তি। যেখানে প্রাণময় আলো আর অনুরাগের বসতিতে ভাষার দ্যুতিময় বিন্যাস:
“শোনো অতল,
বেদনাবোধে ছবি, দুঃখ মানুষ পাথর গান হয়ে ওঠে
আমি গান গাই…”
যে গান আলোর নিঃসরণে অন্ধকার ভেদ করে উঠে আসে জীবন সীমানায়। ‘শ্রীমতীর ভাঙন রোধে’ তা উপলব্ধি হয় কবির হৃদয়ে:
“আমার মধ্যেও জেগে ওঠে মন্দাক্রান্তা একলা একরাত
ভালোবাসা জেগে ওঠে চারিদিকে
মানুষে মানুষে কত সৌহার্দ্য
থাকে গোছানো বাক্য, আর
এভাবে জীবন কাটে মস্ত স্বপ্নে
চারিদিকে জ্যোৎস্নাগ্রস্ত মন, সম্বিৎ পেয়ে ভোর হয়”
এই ভোরেরই আলোকসাম্য ব্যাপ্তি মহানির্বাণের পক্ষবিস্তারে কবির অনুরাগ মোচন আবার দেজান স্টোজানোভিচকেই মনে পড়ায়:
“You are not what you are;
You are darkness
Looking for light within.”
অর্থাৎ আমরা কি সেই আমরা, যারা অন্ধকারের মধ্যেও আলো-কে দেখতে পাই? ভোরের উপলব্ধি কি আমরাও করতে পারি? সুজিত অধিকারী বলেছেন:
“এই মরীচিকার অন্তঃস্থলে তুমি এক উদাসীন আকাশ
তোমাকে আজ একগুচ্ছ ফুল দিলাম, তুমি নির্বিকার”
এই নির্বিকারত্ব ভেঙে জেগে ওঠার আত্মসত্তার জাগরণের উপলব্ধিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন কবি। আমরা তাঁর কবিতার সত্যকে একদিন হয়তো চিনে নিতে পারবো। লংরুটে তিনি হেঁটে গেছেন অসংখ্য রাতের ভেতর দিয়ে। সর্বদা নিজেকে একা একা ভেবেই কাছের মানুষকে খুঁজেছেন। আমরা কি পারবো তাঁর কাছের মানুষ হতে?
দুটি কাব্যের মধ্যেই কবির জীবনদর্শনের সেই বাঁকগুলি আমাদের অন্তর্বতী ভাবনায় করাঘাত করে। অকালপ্রয়াত কবির দীর্ঘছায়া গভীরভাবে মর্মরিত করে আমাদের সঞ্চারিত অনুজ্ঞাকে।
১, ভালোবাসার মুখ শ্লেটে আঁকা ছবি নয়: সুজিত অধিকারী, নৈষ্ঠিক আকাডেমি, নিশিগঞ্জ, কোচবিহার। দাম ১০০ টাকা।
২, শ্রীমতীর ভাঙন রোধে:সুজিত অধিকারী, নৈষ্ঠিক আকাডেমি, নিশিগঞ্জ, কোচবিহার। দাম ১০০ টাকা।
প্রচ্ছদের ছবি: সুজিত অধিকারী।
আপনার মতামত এর জন্য