==================================
বাংলাদশের মাটিতে পা দিয়ে যেমন অনুভূতি হওয়ার কথা ছিলো তেমন হচ্ছে না। নীহারিকা ছোট করে একটা ছোটশ্বাস ফেলল।
আসার কি দরকার ছিল, এখন মনে হচ্ছে না এলেই ভালো হতো। বেশ বেশি রকম ভালো হতো। বিমানবন্দরে কেউ এলো না নিতে – শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুরোটাই এখন খালি লাগছে। নিজের মানুষ না এলে বুঝি এমনই হয়। কত মানুষ গিজগিজ করছে কেবল নীহারিকার জন্য কেউ নেই।
নিজের বিশাল সাইজের দুইটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে একটা ইয়োলো ক্যাবে উঠে পড়ল। আচ্ছা এই গুন্ডা গুন্ডা সাইজের ব্যাগে আত্মীয় নামক অনাত্মীয় দের আবদারের জিনিস ছাড়া আর কি আছে – নিজের কয়েকটা টুকটাক জিনিস, বেশি প্রয়োজনীয় গুলো বাংলাদেশ থেকেই কিনে নেওয়া যাবে।
দশ বছরে কি কি পরিবর্তন হতে পারে চলন্ত গাড়ির জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগল। আসার সময় শুধু মা তাকে জড়িয়ে কেঁদেছিল, ‘’কেমন মেয়ে তুই, বিদেশ বিভূঁইয়ে যাচ্ছিস – আমার কথা না রেখেই! একটা বিয়ে থা করে যা। ওখানে কে তোকে দেখবে। “
নীহারিকা উত্তর দেয় নি। বিয়ে থেকে, সংসার থেকে পালানোর জন্যই সে বিদেশ বেচে নিয়েছিল। চলন্ত গাড়িতে এখন মনে সাময়িক এর জন্য হলেও মনে হচ্ছে বিয়ে করলে খারাপ হতো না। একটা পুতুল পুতুল বাচ্চা থাকতো, আধো আধো কথা বলত। মুখ দিয়ে স্বচ্ছ লালা গড়িয়ে পড়ত গোলাপি ঠোঁট বেয়ে।
নীহারিকার শ্যামলা গাল জোড়ায় ক্লান্তির পর ও হালকা লালচে হয়ে উঠেছে সংসারে ছোট্ট বাচ্চার চিন্তায়। নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক মা মা গন্ধ অনুভব করছে। চট করে নিজের হাতের কব্জি শুকে নিল। হা, একদম মা মা গন্ধ আসছে। কোথা থেকে এল!
- কি হল?
- আফা জ্যাম।
- ওহ,আচ্ছা।
এতক্ষণ চিন্তার ঘোরে কখন যে গাড়ি জ্যামের মাঝামাঝি ঘাপটি মেরে বসে পড়ল, খেয়াল হয়নি। নীহারিকা আবার ডুব দিল, কিন্তু এবার আর বাচ্চার চিন্তা আসছে না। আগষ্টেরর ভ্যাপসা গরমে আর যে চিন্তা আসুক রোমান্টিক সংসার চিন্তা করা যায় না, অন্তত জ্যামে বসে।
গাড়ির জানালায় ঠোকা পড়ছে। সিটে এলিয়ে দেওয়া মাথা কষ্ট করে সোজা করল। আমাদের দেশীয় ভিখারি! চিন্তাটা করেই হেসে দিল।
গাড়ির জানালার ভিখারি তার কোলের সন্তানকে দেখিয়ে কিছু টাকা চাইছে। আচ্ছা কত দিলে সে এই বাচ্চা নিয়ে ভিক্ষা বন্ধ করবে? নীহারিকা চট করে ভাবল তাকে যদি এক লাখ টাকাও দেওয়া হয়, সে এই ভিক্ষা বন্ধ করবে না। এই বাচ্চা বেচেই সে পেট চালাচ্ছে। তার ব্যবসার চমৎকার মূলধন।
গাড়িরর জানালা খোলার আগেই জ্যাম ছুটে গেল। আহ্, শান্তি।
নীহারিকার হুট করে দুচোখ টলমল করে উঠছে। দেশে আসার কোনো দরকার কি ছিল! অদরকারেও তো কত কিছু করি আমরা। ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে আলগোছে মুছল। কাউকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না।
ভিখারি সন্তান বেচে খাচ্ছে। সেও তো নিজেকে বিক্রি করেই খাচ্ছে, নিজের যোগ্যতা বেচে খাচ্ছে। স্রষ্টা প্রদত্ত যোগ্যতা বেচে সে নিজের পেট চালাচ্ছে। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি।
নীহারিকা বিলবোর্ড এর দিকে তাকিয়ে ভাবল, সে একা না আরো অনেকে আছে নিজেকে বেচে খাচ্ছে। ওই বিলবোর্ড এর সুন্দরী নিজের রূপ, যৌবন বিক্রি করছে নিজের পেট চালাবে বলে। তার বাবা আফতাব হোসেন নিজের কূটিল বুদ্ধির জোরে একের পর এক মামলা বিপক্ষের বাদীদের জিতিয়ে দেন, খাবেন বলে।
আমরা সবাই নিজেকে বেচেই খাই। কারোটা চোখে লাগে, কারো টা আড়ালে।
মাথাটা বড্ড বেশি ভার ভার লাগছে। সূদুর জার্মান টু বাংলাদেশ ।পুরোটা জার্নি একা একা! নীহারিকা নিজেকে শাসন করল, সব সময় নিজের কাজ নিজে একা করে অভ্যস্ত। কখনো তো কাউকে ডাকে নি। আজ এই ভ্যাপসা দুপুরে মন এমন করছে কেন। সবটা দোষ বাংলাদেশের মাটির উপর চাপিয়ে দিল। এরকম আদ্র, মায়া মাখা মাটি মানুষের মন দুর্বলতার প্রধান কারণ। কই দেশ থেকে পালানোর সময় তো এত একা লাগেনি।
ভার মাথা আরো ভার হচ্ছে। দশটা বছর দেশের বাইরে, একা। এরমধ্যে মায়ের ব্রেস্ট ক্যানসারে মৃত্যু, বড় ভাইয়ের দুই যমজ বাচ্চার জন্ম, আরো ও কত কি হয়ে গেল। সে কেবল একা শালিক হয়ে রইল।
ছোট একটা ক্যাম্পাসে, একটা প্রেম। অনেক স্বপ্ন ,তারপর ভাঙন – হুট করেই স্কলারশিপ অফার। হুট করে না অবশ্য, এটা প্রেমে ভাঙনের শুরুতেই নীহারিকা আবেদন করে রেখেছিল। আবেদন গ্রহণ করবে জার্মানের বিশ্ববিদ্যালয় এমনটা ভাবেনি, শখের বসে করা। ভালোই হল, দেশে থাকলে কষ্টটা অসহনীয় লাগত।
এক প্রেম তাকে কোথায় টেনে নিয়ে গেল! আচ্ছা , জাবির কেমন আছে? সে তো বলেছিল আমাদের প্রেম অমর! যদি কখনো ছাড়াছাড়ি হয়ও আমি অন্য কোনো মেয়ের হাত ধরব না। অথচ কিছু দিন আগে ‘গট ম্যারিড’ লেখা পোস্ট আপডেট করেছে। এখানে বোধহয় সে শরীর ধরবে, হাত না। বেশ কথা রেখেছে জাবির।
বাগান বিলাসে চাওয়া বাসার সামনে গাড়ি থামতেই হু হু করে কান্নার ঢেউ এল। দশ বছরের চাপা কান্না।
কতদিন পর সে তার বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে আছে। মাথায় একটা স্নেহের হাত, নীহারিকা কিছু বলতে পারছে না। সব স্পর্শের উত্তর হয় না।
আপনার মতামত এর জন্য