==================================
সবাই মিলে দেহটা কবর দিতে এলো নদীর চড়ায়। একটা যশুয়া ফুলও দিতে পারেনা ওই কবরে ,একটা গাছও যে নেই আশেপাশে তার বদলে আগাছা জাতীয় গাছ যাতে না ফুল ফোটে না ফল।কবর দেওয়ার জন্য মাটি খোঁড়ার ক্ষমতা কারো নেই আর বেশিরভাগ লোকই তো দেহ ভাসিয়ে দেয় জাম্মোসির জলে। কিন্তু সুসান খুড়ো মোম্বাসাকে বড় ভালোবাসতেন তাই মরার আগে বলে গিয়েছিলেন তাকে যেন এই গ্রামের জমিতে কবর দেওয়া হয় । তাই একটা উঁচু টিলার মতো দেখে সেখানে খোঁড়ার ব্যবস্থা করা হলো।
দুই একজন হাত লাগাল তবে বেশিক্ষণ পারল না ,কিছুক্ষণ পরেই হাত গুটিয়ে বসে পড়ল, তাই রেবেক একাই খুঁড়তে লাগলো। হঠাৎই ঠং আওয়াজে চমকে উঠলো, লোকমুখে প্রচলিত এই এলাকার কোথাও নাকি রাজা চারম্যানের পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি লুকানো ,তাহলে কি তাই?রেবেক আরো একটু ভালো করে গাঁইতি দিয়ে মাটি সরিয়ে দেখে একটা বাক্স মতন । তখনও মৃতদেহের কাছে তিনজন বসে বাকিরা হয়তো ক্লান্ত শরীরে রোদে বসে থাকতে পারেনি তাই বাড়ি ফিরে গেছে।
পুরোনো জায়গা ছেড়ে নতুন জায়গায় গর্ত খুঁড়তে শুরু করায় সুসানের ছোট ছেলে চেঁচায় ,”ওইখান বাদ দিয়ে অন্য জায়গায় খুঁড়ছিস কেন? “, “ওখানে বোধহয় আগে কারো কবর ছিল ,একটা হার দেখতে পেলাম ,পশুরও হতে পারে।” “তাই”, এই উত্তরে উপস্থিত তিনজন খুশি হয়। তাদের নিজেদের কষ্ট করে কবর খুড়তে হচ্ছে না এই বাঁচোয়া। উঠে গিয়ে রেবেকের কথার সত্যতা যাচাইয়ের ইচ্ছাও তাদের মধ্যে দেখা গেল না।রাতের অন্ধকারে টিমটিমে আলো জ্বেলে এক ছায়ামূর্তি একটা জংধরা শাবল নিয়ে চলল জাম্বোসি নদীর তীরে।
পর দিন প্রচুর পরিমাণে ভুট্টার দানা কিনে নিয়ে এল রেবেক। বীজ গুলো পুঁতলো নিজের বাড়ির উঠোনে। দু’একজন অবশ্য হাসলো বললো, “কিরে নিজে না খেয়ে শেষে জমিতে নষ্ট করছিস?ও সব কিছু হবার নয়! “কিন্তু এসব কথায় কান না দিয়ে ও খুব যত্ন করায় ওই ভুট্টার দানা থেকে চারা বের হল, সেই চারা আস্তে আস্তে গাছে পরিণত হল। তাতে ফুল ধরল , একদিন ওদের উঠোন ভরে উঠলো বেগুনি গাছে হলুদ সোনা রঙের পাকা ভুট্টায় ,সবাই দেখে অবাক।
আনন্দে পাগল হয়ে গেল রেবেক।বেশিরভাগটা নিজেদের জন্য রেখে একটা করে ভুট্টা দিল গ্রামের কিছু বাড়িতে ,তাদের বারবার বলে দিল ওই ভুট্টার দানা থেকে গাছ লাগাতে। তবে বেশির ভাগই সেদ্ধ করে খেয়ে ফেলল কিন্তু যে দু’একজন লাগালো তাদের উঠোন ও ভরে উঠল সোনালী ভুট্টায়। ধীরে ধীরে রাজ্যের এই এলাকার লোকেরা আবার জমিতে ফসল ফলাতে শুরু করল, তার ফলে তারা অনুদান নিলেও অনুদান না নিলে তাদের চলবে না এমন নয়! অবশ্য কাজটা একদিনে হয়নি এর জন্য রেবেককে ওদের বারবার বোঝাতে হয়েছে, শেষে কাউকে কাউকে ভয় দেখিও বাধ্য ও করতে হয়েছে।
একদিন এ খবর গেল এলিনার কানে ,সঙ্গে সঙ্গে স্যাডউইক লোক পাঠালো রেবেককে ধরে আনতে। এলিনার সামনে সটান দাঁড়িয়ে রেবেক, এলিনা যুবকের সোজা মেরুদন্ড দেখে অবাক! ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে জানল ,আজ বহুদিন ও নিজের উঠোনে ফসল ফলায়। রাজকোষ থেকে দেওয়া অনুদানে ওদের সবার মেরুদন্ড দুর্বল হলেও , নিজের ফলানো ফসল খেয়ে ওর মেরুদন্ড এতটা সবল, সোজা। এলিনা রেগে গেলেও এখন স্যাডউইককে ভর্ৎসনা করার সময় নয় ,পরে এ বিষয়ে কথা বলবে ।
রেবেক কে এলিনা জিজ্ঞাসা করে, “শুনছি তুমি নাকি ভুট্টা ফলিয়েছে?”, ” আজ্ঞে হ্যাঁ মহারানী”, এর উত্তরে এক ক্রূর হাসি হেসে এলিনা বলল ,”কেন ,তুমি তো অনুদান পাও, তার পরেও কেন ফসল ফলাও? “,”পেট ভরে না মহারানী”, এলিনা প্রচন্ড রেখে উঠল তবে মুখে শান্তভাব বজায় রেখে বলল, “ঠিক আছে,ঠিক আছে তোমার অনুদান বাড়িয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু একটা শর্তে ,তুমি আর ফসল ফলাতে পারবে না।”,”কিন্তু কেন মহারানী?”,”কোন কিন্তু না! এই কে আছিস ,ওকে আরও দুশো দিনার দিয়ে দে”। রেবেক অনুদান নিল না, সেই দুশো দিনার গেল স্যাডউইক এর পকেটে।
কিন্তু রেবেক আবারও ফসল ফলালো উঠোনে, এমনকি গতবারের তুলনায় আরো বেশি ফসল। ওর দেখাদেখি আরো অনেকে নিজের উঠোনে ফসল ফলাতে শুরু করলো । একদিন এলিনার সৈন্যরা সমস্ত ভুট্টা গাছ, আখের ক্ষেতগুলো কেটে, মাড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে গেল। যারা দেখভাল করছিল তাদের ধরে নিয়ে গেল রাজপ্রাসাদে,এদের মধ্যে ছিল রেবেক ও। সকলকে দুশো করে দিনার দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল এই শর্তে যে তারা আর ফসল বুনবেনা । কিন্তু রেবেককে আটকে রাখা হলো প্রাসাদের এক অন্ধকার কুঠুরিতে ।
একদিন হঠাৎ রাতের অন্ধকারে জেলের কুঠুরি গেল খুলে , রেবেক অবাক, একি ?রাজা আরডেন আর তার পাশে কে ও ?পরী নাকি? রাজা নিজেই পরিচয় করিয়ে দিলেন ,”ইসাবেলা “,ইসাবেলা !এই সেই ইসাবেলা? নদীর ধারে মাছ ধরতে ধরতে যাকে প্রায়ই রাজপ্রাসাদের জানালায় আনমনে বসে থাকতে দেখেছে !
এত সুন্দর মানুষ ও হয়? কিন্তু ওর ঘোর কাটতে না কাটতেই ইসাবেলা তাড়া দেয়, “তাড়াতাড়ি করো !পালিয়ে যাও! এখন সবাই খেতে গেছে , এই সুযোগ”। এখানে একমাত্র বন্দী রেবেক আর কারো অপরাধ করার ক্ষমতাই নেই তাই পাহারা ততটা কড়া নয় । রাজা রেবেকের হাতে একটা ছোড়া তুলে দিয়ে বললেন, “পালাও ,যদি কোন সৈনিক তোমার পিছু নেয়, তখন তোমার এটা কাজে লাগবে। “
চুপি চুপি রাতের অন্ধকারে বের হয়ে আসতে গিয়ে দেখল ,একটা বিরাট হল ঘর । তাতে সব সৈনিকেরা খাবার শেষে ক্যানক্যান খেয়ে বেঁহুশ, আধো হুঁশে! কি জানি কিছু মেশানো ছিল কিনা এদের পানীয়ে? বাইরে বের হয়ে উঠে গেল প্রাসাদের দোতলায়, জানালা বেয়ে।শোবার ঘরে তখন খাটের ওপর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন স্যাডউইক আর এলিনা।
নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে একমুহূর্ত দেরী না করে সোজা ছোরাটা রেবেক বসিয়ে দিল স্যাডউইক এর বুকে । এই নিষ্ঠুর শয়তানটাও সব অন্যায়ের সমান অংশীদার , মুখটা চেপে ধরায় খুব একটা শব্দ করতে পারল না শয়তানটা।
এরপর স্যাডউইক এর মাথার বালিশটা চেপে ধরল এলিনার মুখে। নেশার ঘোরে বেশি ছটফট করতে পারলনা কুচক্রী রানী । কিছুক্ষন ছটফট করার পর এলিনাও স্যাডউইক এর নরকের সঙ্গিনী হলো।
উত্তরাধিকারী হিসেবে আরডেন কে রাজা করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি তা ফিরিয়ে দেন। রানী হলেন ইসাবেলা ,রাজা চারম্যান এর লুকোনো সম্পদ রেবেক এনে দিল ইসাবেলাকে ,কিন্তু ইসাবেলা তা বিলিয়ে দিল সব জনগণের মধ্যে । অনুদান দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হলো, তার বদলে দেওয়া হল শস্য দানা , যাতে আবার নতুন করে ফসল ফলানো শুরু করতে পারে মোম্বাসার লোকেরা ।
যতদিন না ফসল পাকছে ততদিন অবশ্য অনুদান চালু থাকবে।আরডেনের ইচ্ছা অনুযায়ী রানী ইসাবেলার বিয়ে হয়ে গেল রেবেকের সঙ্গে ,উভয়ের সম্মতিক্রমে । পরদিন সকালে আবার বেগুনি আকাশ রাঙা করে উঠল এক নতুন আশার সূর্য,বহুদিনের অন্ধকার লোভের কাল রাত্রি কাটিয়ে ।
আপনার মতামত এর জন্য