ইন্দুর মনটা কিছুতেই ভালো না । বাড়ী ভর্তি লোকজন সবাই আনন্দে মশগুল। হবে নাই বা কেন ? আজ যে ওর সাধ।
ওরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে প্রায় বছর দুয়েক। প্রথমে কেউ ওদের সম্পর্কটা মেনে নিতে পারেনি। না অভিষেকের বাড়ি না ইন্দুলেখার বাড়ি ।
একমাত্র মেয়ের এরকম বিবেচনাহীন কাজ কোন মতেই মেনে নিতে পারেননি ছাপোষা সমীরণ বাবু। সমীরন রায়ের সম্বল বলতে ছিল ওই এক মেয়ে। সে কিনা কলেজ শেষ হতে না হতেই বিয়ে করতে চায় অভিষেককে !
করুক তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়াতে তো হবে? যে শিক্ষা তিনি মেয়েকে দিয়েছেন, আত্মনির্ভরশীলতার সেই শিক্ষার যখন কোন মূল্য মেয়ে দিল না, ওর কাছে বাইশ তেইশ বছরের বাবা মা এর চেয়ে একটা তিন বছরের পরিচিত ছেলে যখন বেশি আপন হল, রাগে অভিমানে, গভীর হেরে যাওয়া অনুভূতি নিয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি সমীরন বাবু আর তার স্ত্রী অলকা দেবী মেয়ের এই সম্পর্ক।
তাই মেয়ের বিয়ের কথা বলতে, অভিষেককে সাফ জানিয়ে দেন নিজেদের অপচ্ছন্দের কথা । সারা জীবন বেসরকারি অফিসের কেরানিগিরি করে কাটিয়েছেন, স্বপ্ন ছিল মেয়ে একটা সরকারি চাকরি করবে, নিদেনপক্ষে জামাই হবে সরকারি চাকুরে।
বাবা মা যে ছেলে মেয়েদের জন্য কত স্বপ্ন দেখেন তা সবসময় যুক্তি বুদ্ধির ধার ধারে না, কিন্তু তাতে সন্তানের মঙ্গল চিন্তা যে সবসময়ই থাকে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।
বাবা-মার এই গোয়ার্তুমি ভাবটাই ভাল লাগেনি ইন্দুর।সরকারি চাকরি করে না বলে অভিষেক পাত্র হিসেবে ফেলনা? এ বাবা মায়ের বাড়াবাড়ি !তাই বাবা অভিষেককে না বলতেই সেদিন রাতে ও এক পোশাকে বের হয়ে আসে অভিষেকের সঙ্গে।
এ বাবার ভারি অন্যায় নিজের সরকারি চাকরি পায়নি বলে তাকে সরকারি চাকরি পেতেই হবে অথবা তার হবু জামাইকে !এ বাবার ভারী অন্যায় আবদার! আমাদের দেশেই এসব চলে !বাবা মায়ের উপর ভীষণ বিরক্ত ইন্দু।
বিয়েতে অভিষেকের বাড়ির লোকজন ও অসন্তুষ্ট। হঠাৎ যদি বাড়ির বড় ছেলে বলা নেই কওয়া নেই একজন মেয়েকে মাথায় সিঁদুর দিয়ে এক সন্ধ্যায় বউ করে আনে তাহলে কারই বা মাথার ঠিক থাকে? তবে এনেই যখন ফেলেছে তখন তো আর ফেলে দেওয়া যায় না ? তাই নিমরাজি হয়েও অভিষেকের মা শান্তা দেবী বউ বরণ না করলেও তাড়িয়ে দেয় নি।
ধীরে ধীরে নিজের ব্যবহারে, কাজে-কর্মে বাড়ির সবার আপন হয়ে উঠেছে ইন্দু। ওকে বেশ ভালোবাসে সবাই। শ্বশুর শাশুড়ির কাছে ও বেশ প্রিয় । কিন্তু বাবা মা? না ,বাবা মা মেয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি । যে মেয়ে নিজের ভালো বোঝে না, তাকে আর কি বলবেন? চাকরির বদলে বিয়ে কোনো অপশান হলো?
বিয়ের পর পরই অভিষেকের একটা ভালো প্রমোশন হলো । সবাই তো বৌয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, লক্ষ্মীমন্ত বউ, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সন্তান পেটে আসার পর অভিষেক একটা গাড়ি ও কিনলো! এবার সবাই ধরেই নেয় ,গর্ভের সন্তান আরো বেশি সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসছে সবার জন্য।
যত্ন আত্তিতে তাই হবু মায়ের কোন ত্রুটি শাশুড়িমা রাখেননি । নিজে হাতে পা ফুললে ইন্দুর পায়ে তেল মাখিয়ে দিয়েছেন, দেওর ননদ মিলে ইন্দুর খাবারের অরুচি সামলেছে অত্যন্ত আদর করে, অভিষেকের ও খুব কড়া নজর ইন্দুর স্বাস্থ্যের প্রতি।এমনকি শ্বশুরমশাইও মাঝে মাঝে বৌমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসতেন ।
এত আদর, এত যত্ন তবু কেমন যেন কান্না পেত ইন্দুর। ফাঁকা ফাঁকা লাগতো, মা! মায়ের অভাব যেন সবসময় খোঁচা দিত ওকে। মা বাবা কেন এত নিষ্ঠুর হয় ?ও প্রেগন্যান্ট জেনেও ওর সঙ্গে কথা বলল না ।
অভিষেক গিয়েছিল আজকের সাধের নিয়ন্ত্রণ করতে। ওনারা স্পষ্ট জানিয়েছেন আসতে পারবেন না।ফোনও করেছিল ইন্দু ,নাম শুনেই মা ফোন কেটে দিয়েছেন। মাগো! মা বাবাও এতো নিষ্ঠুর হয় ?
একটা লাল আসন পেতে ইন্দুকে বসানো হয়েছে। পরণে নতুন শাড়ি, গলায় নেকলেস, অভিষেক দিয়েছে, উপহার । খুব ভারী নয়, তবে নতুন ।
সামনে পঞ্চ ব্যঞ্জন, প্রদীপ, শঙ্খ ধ্বনি, উলু ধ্বনি।সবাই ওকে আশীর্বাদ করছে।এত আনন্দ কিন্তু কিছুতেই ইন্দু আনন্দিত হতে পারছে না, কেন কে জানে ?শুধু যন্ত্রের মত মাথা নিচু করে সবার পা ছুঁয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ কে একজন যেন বলল ,”বৌমা তোমার মা এসেছে”, “মা! ”
ও তাড়াতাড়ি মাথা তুলে এদিক ওদিক চায়, “ঐতো ঐতো,সেই মুখ! দুটো দুটো বছর দেখতে চেয়েছে যে মুখ খানা। হ্যাঁ তার পাশে একটা রোগা ফর্সা সাদা গোঁফ ,সাদা চুল সেই প্রিয় মানুষ টা! মা-বাবা!
ইন্দু তাড়াতাড়ি আসন ছেড়ে উঠতে যায়, কিন্তু অলকা দেবী এসে বাধা দেন ,”উঠিস না মা”। ইন্দুর মুখ থেকে একটা বুক ফাটা চিৎকার বের হয়ে আসে, অলকা দেবী মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রাখেন। ইন্দু চিৎকার করে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের বুকে, আজ তার সত্যিকারের সাধ পূরণ হয়েছে যে।
.
আপনার মতামতের জন্য
আপনার মতামতের জন্য