আবার,আবার আর একটি যুবদিবস আমাদের মননের কুলে এই কোভিড কালে পৌঁছে গেল।ভারত মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন ,আমাদের একান্ত আপন, স্বামী বিবেকানন্দ আজকের মতো এক শীতের রাতে সূর্যোদয়ের কিছু আগে যাকে ব্রাহ্মমুহূর্ত বলে ঠিক সেই সময়ে শিমুলিয়ার দত্ত পরিবারের বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরীদেবীর কোল আলো করে জন্মেছিলেন।
নিজের মুক্তির কথা বলে,শুকদেবের মতো শুধু ধ্যান করে নিজের জীবন কাটানোর কথা বললে গুরুর কাছে ব্যাপক ধমক খান।গুরুদেব পরমহংস রামকৃষ্ণদেব তাকে সোজা জানিয়ে দেন।এলে বেলে যা হোক কিছু একটা হলে চলবে না তাঁকে হতে হবে জ্যান্ত মহীরুহ, একেবারে বিরাট বটগাছ।যার স্নেহের পরশ বলে শত সহস্র প্রাণী ও পাখি নির্দ্বিধায় বাসা বাঁধতে পারে ;কেন না তাঁর নরেন যে সপ্ত ঋষির শ্রেষ্ঠ ঋষি।পাখিদের মধ্যে মাদা পায়রা ভুজুং ভাজুং -এ বিশ্বাস করে না।
প্রতিপক্ষের অসার যুক্তিকে তলোয়ারের মতো যুক্তি দিয়ে কচকচ করে কাটে।কুস্তি লড়ে,সাঁতারে পারদর্শী,গপ্পোবাজ,তবলা বাজায়,গলা সাধে মনের জোর সৎসাহসের জন্য বেশ বলিষ্ঠ ।এই নরেন দত্তের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন পূর্ববর্ধমান জেলার হাটগোবিন্দপুরের কাছে দত্ত দেরিয়াটোনের বাসিন্দা। লোকে বলে কায়স্থ পরিবারের মজ্জায় সন্ন্যাস রোগ সেঁধিয়ে আছে।দাদু দুর্গাদাস স্ত্রী পুত্র রেখে দিব্যি সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন।পরনে পেরেছেন গেরুয়া বসন।
তাঁর ছেলে বিশ্বনাথ দত্ত নামজাদা উকিল।কলকাতার বাজারে ছেলে মেয়েদের নিয়ে সংসারে স্বচ্ছলভাবে কাটাতে না পারার কোন কারণই ছিল না যেখানে সেখানে সাদা পোষাকের এই বিশ্বনাথ যেচে প্রতিবেশীর উপকারে গেছেন।নিজের লেখা উপন্যাস নিজের খরচায় ছাপালেন তাও আবার অন্যের নামে।নিজের রোজগারে কেনা ভিটেতে প্রতিবেশির নাম ঢুকালেন দলিলে।বিশ্বনাথ দত্তের এই সাধু মনের বিপরীতে মধুমেহ রোগে প্রয়াণের পর পড়শিরা নখ দাঁত বিস্তার করে সদ্যবিধবা ভুবনেশ্বরী দেবীকে কাচ্ছাবাচ্ছা নিয়ে গৃহচ্যুত করে।
বংশানুক্রমে চলতে থাকা এই সন্ন্যাস রোগ যাতে নরেন দত্তের মধ্যে না সংক্রমিত হয় সে জন্য নরেনের জন্য কনের সন্ধান চলছিল।মাঝপথে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল হঠাৎ পিতার মৃত্যুতে। নরেনের পিতা আর কয়েক জন সাধারণ পিতার গড় বলে আমরা যদি মনে ধরে রাখি তবে আমরা তাঁর প্রতি খুবই অন্যায় করব। একদিন বিশ্বনাথদত্তের শরীর যখন খুব অসুস্থ তখন পুত্র নরেন জিজ্ঞাসা করলেন ,আমার জন্য কি রেখে যাচ্ছেন ।
পরম মমতা আর স্থির বিশ্বাসে বিশ্বনাথ পুত্র নরেন কে একটি বড় আয়নায় দেখতে বললেন তার রেখে যাওয়া সম্পদটিকে। চোখ বোলাতে বোলাতে হয়তো নরেনের সেদিন রাগ হয়েছিল। কিন্তু আত্মভোলা বিশ্বনাথের দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় আসমুদ্র হিমাচল দেখেছে–সত্যিই তার আধার কত বড়।নরেনের মধ্যে যে আগুন তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর পূজারি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তা টেনে বের করেন।
তিনি নরেনকে নিজ হাতে গড়েছেন।তাঁকে জগতের হিতে সৎসংকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে তৈরী করে দিয়েছেন।বারবার মা ভবতারিণী কাছে পাঠিয়ে দুঃখ মোচনের প্রার্থনা করতে পাঠালে, নরেন প্রত্যেকবারই মায়ের কাছে মা আমাকে জ্ঞান দাও,ভক্তি দাও, বিবেক বৈরাগ্য দাও বলেন ।শেষ মেস মোটা ভাত কাপড়ের অভাব যাতে না হয় সে জন্য তিনি দুটো স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রীম অর্থাৎ মহেন্দ্রলাল গুপ্তকে একটা বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জন্য ধরেন।
কথায় কাজও হয়।বিদ্যাসাগর মশায়ের জামাই যে বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি ছিলেন সেই মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন।কিন্তু সহকর্মীরা লাগাতার পিছনে লাগায় তাঁকে সেখান থেকে সরানো হয়।আসলে যিনি গোটা বিশ্বটাকে একটা শ্রেণীকক্ষ বানাতে পারেন তাঁকে বিদ্যালয়ের ছোট্ট গণ্ডীতে আবদ্ধ করার ক্ষমতা কুচক্রীদের হাতে কেন থাকবে।চরমতম অনিশ্চয়তা, চূড়ান্ত অভাব আর প্রিয়মানুষদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে সামনের চেনা পথ কণ্টকাকীর্ণ হয়ে ওঠে ।
এই সময় গৌরমোহন মুখার্জি লেন একমাত্রপথ ছিল।এই ঠিকানা শুধু তার জন্মস্থান খানে নয়।ই ছিল ভুবনেশ্বরী দেবীর মাপের বাড়ি, বিধবা মা তখনো বেঁচে তিনি সকন্যা নাতিপূতিদের নিয়ে ভারতের নতুন ভাগ্য অন্বেষণে সহায়তা করলেন। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি প্রথম প্রথম তিনি আকৃষ্ট হন।ঈশ্বর আধ্যাত্মিকতা ঈশ্বরের ঠিকানা এসব নিয়ে নিজেই নিজের মনে মনে যখন হোঁচট খাচ্ছেন এমন সময় দক্ষিণেশ্বরে সাক্ষাত পেলেন পরমহংসদেবের।চুরমুর করে ভেঙে পড়ল সব জীর্ণ জমাট দুর্ভাবনা, তিনি পেলেন আলোর ঠিকানা,কামিনী কাঞ্চনে আসক্তিহীনতার নির্মল আনন্দের রেণুমেখে তিনি গুরুর দর্শনকে ছড়িয়ে দিতে গুরুভাইদের নিয়ে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ গঠন করলেন।
বলরাম বসুর বাড়ি,কাশীপুর উদ্যান বাড়ি, বরানগর হয়ে বেলুড়ে নিরালম্ববাবুর বাগান বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশন তৈরী হয়।পরে আত্মারামের কৌটো নিয়ে বর্তমানের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন গঠিত হয় বহুমানবের সেবার ঋদর্শ নিয়ে ।ইতিমধ্যে ঐমঠ মেশনের সর্বোচ্চ আসনে সারদাদেবীকে বসান হয়।এই মাকে স্বামীজি মনে প্রাণে জ্যান্ত দুর্গা বলে মনে করতেন।রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের গতি প্রকৃতি নিরূপণে তিনি ঠিলেন হাই কোর্ট । কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চারশো বছর পূর্তিতে শিকাগো শহরে বিশ্বধর্ম সভা হতে চলেছে।অনাহূত স্বামীজি সেখানে যাওয়ার মনস্থিরকরতেই হাইকোর্টের নির্দেশ এলো।সারদাদেবী তাকে বোঝালেন,ঠাকুরের আর্শীবাদ রয়েছে তাঁর ওপরে তাই নির্দিধায় তিনি যেতে পারেন।
মাদ্রাজ থেকে পেনিনসুলা জাহাজে চড়ে তিনি পাড়ি দেন।সেখানে যোগদানের পর ,বক্তৃতা করার পর সভাস্থল মূর্হমূর্হ হাততালিতে ফেটে পড়ে।ভোগবাদের সাম্রাজ্যে ত্যাগের মন্ত্র রাতারাতি স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হল।পরাধীন ভারতবর্ষের সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে উঠলেন আমেরিকার আকর্ষণ । মানুষকে ভালবেসে কাছে ডেকে তার সুবিধা অসুবিধা র খোঁজ খবর নিয়ে সাধ্যমত সহযোগিতা যে ধর্মের প্রকৃত ক্ষেত্রহতে পারে,এবং মন যে মন্দির মসজিদ গীর্জার চেয়ে বড় এবং প্রকৃত ভালবাসাই বিশ্বজয়ের মূলহাতিয়ার তা তিনি প্রমাণ দিলেন।দুর্বল,দরিদ্র,ভাগ্যাহত,লাঞ্ছিত মানুষ হলেন সাক্ষাত নারায়ণ।তিনি জোরের সঙ্গে ধর্মের পুরাতন ধ্যান ধারনার খোলনলচে বদলে দিলেন।
তিনি সদর্পে সিংহবিক্রমে বললেন,যে ধর্ম বিধবার অশ্রু মোচন করতে পারে না,ক্ষুধিতের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারে না তা ধর্ম ই নয়।হিন্দু সন্ন্যাসী হয়েও তিনি বললেন,যে ঈশ্বরের বিশ্বাস করে না সে নাস্তিক নয়,নাস্তিক সে যে নিজেকে বিশ্বাস করে না।পরাধীন ভারতবর্ষে হাত ভাঙা ,পা ভাঙা,রঙ চটা ঠাকুর দেবতাকে সরিয়ে এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ বলে তিনি ভারত মাতার সার্বিক শ্রীবৃদ্ধির জন্য পায়ে হেঁটে সমগ্রভারত পরিক্রমা করলেন।অশিক্ষা,দারিদ্র,কুসংস্কার,অবিশ্বাস,অহংকার,হিংসা থেকে এই দেশ আর দেশবাসীকে বাঁচানোর জন্য তিনি বললেন,মূর্খ ভারতবাসী,চণ্ডাল ভারতবাসী ,দরিদ্রভারতবাসী,অজ্ঞ ভারতবাসী ,মুচি,মেথর ভারতবাসী আমার ভাই, আমার রক্ত,।
সর্ববিধ রোগের সেরা ওষুধ যে শিক্ষা তা অন্তর দিক উপলব্ধি করে তিনি বললেন,ম্যান মেকিং এডুকেশন ইজ মাই মিশন।দেশ ও দেশবাসীর উন্নয়নে তিনি থ্রি-এইচের তত্ত্ব রাখলেন আমাদের সামনে।প্রথম এইচ হল হ্যান্ড,আমাদের হাত এই হাতকে কোনমতেই দান গ্রহণের পাত্র করলে চলবে না।
সেবা ,দান এবং ভালো কাজেই লাগাতে হবে,দ্বিতীয় এইচ হল হেড,আমাদের মাথা,এই মাথা কোনমতেই যেন পরানুকরণ,পরানুবাদ ও অপরের ক্ষতির চেষ্টা যেন সেখানে ঠাঁই না পায় সে বিষয়ে সাবধান করেন,মগজাস্ত্র সব সময় মানুষের কল্যাণে আসুক স্বামীজির ছিল এই নির্দেশ ।আর তৃতীয় এইচ হল হার্ট বা হৃদয় ।হৃদয়কে বিশাল ও মহৎ করার চেষ্টা যে কোন সুস্থ মানুষের করা দরকার।মহৎ হৃদয়ের দান উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারো নেই।পরমহংসের তো আগেই বলেছেন ,ভক্তের হৃদয় ভগবানের বৈঠকখানা ।
সরলতা,সহজতা আর মুক্তমনের ছোঁয়ায় সেটি অচিরেই সত্য শিব আর সুন্দরের প্রাণভোমরা হয়ে উঠতে পারে।এই চেষ্টা আমাদের কায়মনে করে যেতে হবে লক্ষ্যে না পৌঁছান অবধি। বিশ্বধর্ম সভায় অভাবনীয় সাফল্যের পর তিনি দেশে এলে এদেশের যুবকের দল ঘোড়ার গাড়িতে স্বামীজিকে চড়িয়ে নিজেরা টানেন।স্বামীজির সম্বর্ধনা সভায় ভারতবর্ষে থেকে প্রতিনিধিত্ব করা প্রতাপচন্দ্র মজুমদারকে ধরা হলে তিনি কুয়েতের সভায় সভাপতিত্ব করবেন না বলে স্পষ্ট জানান। তবুও সম্বর্ধনা হল।সম্বর্ধনা সভায় বাড়তি খরচের ব্যয়ভার স্বামীজিকে বহন করতে হয়।
স্বামীজির জীবনের শেষ পর্বে একজন ডাক্তারকে ডাক দেওয়া হয়েছিল।ঐ ডাক্তারবাবু তার নিজ হিসাবে যে টাকা নিয়েছিলেন আজকে তা দশ হাজার টাকার বেশি। সন্ন্যাসী হবার পরেও তিনি চা পান করতেন বলে পুরসভা বেলুড় মঠের ওপর বাড়তি কর আদায় করত।
এক দিদি আত্মহত্যা করেন,অভাবী মায়ের জন্য টাকা পাঠানো, উৎখাত হওয়া সিমলেপল্লীর বাড়ি পুণদখলের জন্য মৃত্যুর কদিন আগে পর্যন্ত আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়া, মঠ মিশনের জমি জমা কেনা,সাধু ও ভক্তদের সুখ দুঃখে পাশে থাকা,সর্বোপরি ভারত ও ভারতবাসীর জন্য সবসময় চিন্তাভাবনা করতে করতে অনাহারে ,অর্ধাহারে তিল তিল করে তিনি জীবনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে মাত্র৩৯ বছর বয়সে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন।
এই মহামানবের চরিত্রে কালি ছেটানোর লোকের অভাব সেদিনের যেমন ছিল না,আছো নেই,তবে আর একটি বিবেকানন্দ না হলে এই বিবেকানন্দ কি ছিলেন তা বোঝানোর দায় কার ওপরেই বা দেওয়া যায়?
আপনার মতামতের জন্য