‘আজাদ হিন্দ ফৌজের’ নেতৃত্ব দেবার ডাক, পরাধীন ভারতের বিপ্লবীদের পাশে বিশ্বের নানা দেশের সমর্থন আদায়ের আশায় ছদ্মবেশে দেশ ছাড়লেন তিনি। এ তো আমরা জানি। নেতাজীকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছিলেন তাঁর মেজদা শরৎ বসুর পুত্র শিশির বসু তাও আমরা জানি। কিন্তু কলকাতার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে মধ্যরাতে নেতাজীর সেই মহানিস্ক্রমণের অন্যতম প্রধান সহযোগী নেতাজীর সেজদা সুরেশ বসুর দ্বিতীয়া কন্যা ক্ষণজন্মা ইলা বসুকে ক’জন মনে রেখেছি!
নেতাজী নিজের বাড়িতে নজরবন্দী দীর্ঘদিন। বাড়ির চারপাশ ঘিরে রেখেছে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। পরিকল্পনা মাফিক একদিন নেতাজী ঘোষণা করলেন যে কারো সাথে দেখা করবেন না, আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন থাকবেন। তাঁর ঘরের একপাশে রাখা হলো বাঘের চামড়া, সামনে গীতা আর জপমালা। ঘরের পর্দা এমনভাবে টাঙানো হলো যে বাইরে থেকে কিছু দেখা যাবেনা। খাবার-দাবার সব ঘরের দরজায় রাখা হতো। গৃহত্যাগের কিছুদিন আগে ধর্মতলার ওয়াছেল মোল্লার দোকান থেকে পাজামা,শেরওয়ানী ও জিন্না টুপি কেনা হলো। রাধাবাজারের একটি প্রেস থেকে ছাপা হলো ভিজিটিং কার্ড। তাতে লেখা- ‘মহম্মদ জিয়াউদ্দিন, ট্রাভেলিং ইনস্পেক্টর, দ্য এম্পায়ার অফ ইন্ডিয়ান লাইভ অ্যাসিওরেন্স কোম্পানি, সিভিল লাইন, জব্বলপুর’।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল দাদা শরৎ বসুর গাড়িতে যাবেন কিন্তু সে গাড়ি খুব পরিচিত হবার কারণে ১৯৩৭-এ শিশির বসুর ৪৬৮০ টাকায় কেনা গাড়িতে ( NO-BLA7169 ; যা আজও সংরক্ষিত আছে এলগিন রোডের বাড়িতে ) যাওয়া হয়। ১৯৪১-এর ১৬-ই জানুয়ারির মধ্যরাত। ঘড়িতে রাত একটা বেজে পচিঁশ। শেরওয়ানি-ঢোলা পাজামা- জিন্না টুপি পরিহিত জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে বেরলেন নেতাজী।
তার অনেক আগেই শুরু হয়েছে ইলা বসুর কাজ। নেতাজী সঙ্গে করে যে জামাকাপড় লেপ-বিছানা নিয়ে যাবেন তা সব বেঁধে বেডিং করলেন। সব কাপড়ে ৬ নম্বর লিখে রাখলেন। ৬ একটি সাঙ্কেতিক সংখ্যা। কি সঙ্কেত? না নেতাজী যেহেতু ষষ্ঠ সন্তান তাই- ৬, যাতে জাহাজে পরে নেতাজী সহজেই নিজের বেডিং খুঁজে পান। সকালে তাঁর প্রিয় রাঙাকাকু অর্থাৎ নেতাজীর জন্য দক্ষিণেশ্বরে দিয়ে এসেছেন পূজো। রাতে বাড়ির পোষ্য কুকুরটিকে তিনতলার ঘরে বেঁধে রাখলেন যাতে বেরনোর সময় চিৎকার করতে না পারে। মহানিস্ক্রমণের আগে নেতাজী তাঁর কপালে চুম্বন দিয়ে আশীর্বাদ করলেন- ‘গড ব্লেস ইউ’। তারপর আরও একঘণ্টা ঘরের আলো জ্বালিয়ে নেতাজীর ভূমিকায় বসে থাকলেন যাতে কারো সন্দেহ না হয়। নেতাজী চলে যাবার পরও পরবর্তী দশদিন নেতাজীকে খাবার দেওয়া বা সরিয়ে নেবার ভান করেছিলেন তিনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে গোপন এবং গোয়েন্দাদের বোকা বানানোর জন্য।
চালক শিশির বসু। সওয়ারী নেতাজী সুভাষ। হাওড়া ব্রিজ ধরে ব্যান্ডেল-বর্ধমান-দূর্গাপুর-আসানসোল রুট হয়ে ধানবাদ। সেখানে শরৎ বসুর বড়ছেলে চিকিৎসক অশোক বসুর বাংলো। পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে জিয়াউদ্দিন সেজে বাইরের ঘরে থাকলেন নেতাজী। যাতে বাড়ির পরিচারকরা কিছু বুঝতে না পারেন। সন্ধ্যার পর গোমো স্টেশনে তাঁকে পৌঁছে দিলেন শিশির, অশোক এবং তাঁর স্ত্রী। দিল্লি-কালকা মেলে নেতাজী রওনা দিলেন পেশোয়ার ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর-বার্মা-জাপান। আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক……. পরাধীন ভারতের সবচাইতে স্বর্নময় ইতিহাস। এক বাঙালির বিশ্বকাপাঁনো তেজ…….
কিন্তু ইলা বসু! কি হলো তাঁর! সেপ্টেম্বর
১৯৪৩-এ এক সন্তানের জন্ম দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই অকাল প্রয়াত হলেন এই সদ্য তরুণী। নেতাজী তখন রণাঙ্গনে, রেঙ্গুন কিম্বা সিঙ্গাপুর অথবা জাপানের পথে। যাঁর মাথায় হাত রেখে তিনি বলেছিলেন ‘গড ব্লেস ইউ’ সেই প্রিয় ইলার এই পরিণতি হয়ত তিনি জানতেও পারেননি! ইতিহাস কি মনে রাখবে নেতাজীর মহানিস্ক্রমণের পথে ইলার ভূমিকার কথা!!!!!!