মাধব বাবুর ছেলে অসীম আজ ভূগোলের শিক্ষক হিসেবে হুগলীর ‘সুকান্ত স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে ‘যোগ দিতে গেছে. মাধব বাবুর বড় ছেলে অসীম পড়াশোনায় বরাবরই ভালো. মাধব বাবু নিজেও একজন ভালো শিক্ষক ছিলেন. তাই এই মহৎ পেশার ওপর তাঁর দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক. মাধব বাবু একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছেন, ‘ছাত্র -ছাত্রীরাই তোমার একান্ত আপন. তাদের স্বার্থে সব সময় কাজ করে যাবে. আর কোনোদিন ক্লাস ফাঁকি দেবে না. ‘
কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অসীম বদলে গেল. অসীম পুরোদমে প্রাইভেট টিউশন শুরু করলো. ঐ স্কুলে একটা গ্ৰুপ আগে থেকেই ছিল. অসীম সেই দলে যোগ দিল. দেরী করে বাড়ী ফেরার প্রশ্নেই মাধব বাবু আসল কথাটি জানতে পারলেন.
প্রাইভেট টিউশন করা নিয়ে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অধিকাংশ শিক্ষক তা মানেন না. এই ভাবে উপার্জিত টাকা আয়কর রিটার্নেও দেখান না. মাধব বাবু আর দশ জনের মতো এও জানেন, রাজ্যের সব স্তরের শিক্ষকদের বেতন এখন যথেষ্ট সন্তোষজনক. তাই চাকরিতে ঢুকেই এই অতিরিক্ত রোজগার বা উঞ্ছবৃত্তির কোনও প্রয়োজন ছিল না. কিন্তু অসীম নিজের ছাত্র জীবনে প্রাইভেট টিউশন কয়েকটি বিষয়ে নিলেও বাবার কাছ থেকে প্রতি মাসে আলাদা আলাদা খামে ভরা টাকা নিতে সত্যিই লজ্জাবোধ করতো.
আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেও বদলে গেল.
মাধব বাবু অসীমের বিয়ে নিয়ে স্ত্রী বন্দনার সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে জানতে পারলেন, উপার্জনশীল মেয়ে ছাড়া সে বিয়ে করবে না.
মাধব বাবুর ছেলের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধের শুরু এই আদর্শ গত কারণেই. গ্রাজুয়েট মেয়ে সীমার পাত্র দেখা চলছে.
অসীম সেকথা জেনে শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া না দেখানোয় আরও স্পষ্ট হয়ে গেল বিশেষ কিছু সে দিতে পারবে না. কার্যক্ষেত্রে হলোও তাই.
অসীম জানালো সে একটি লাখ টাকা দামের মোটর সাইকেল অর্ডার দিয়েছে. যাতে স্কুলে যাওয়া আসার সুবিধা হয়. তাই একমাত্র বোনের বিয়েতে সে রিসেপশনএর খরচটা শুধু দিতে পারে. তার বেশী কিছু নয়.
মাধব বাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন –তোমার চাকরি পাওয়া অবধি তোমার মাস্টার ডিগ্রী, বি. এড তৎসহ ভরণ পোষণের জন্য কত টাকা খরচ হয়েছে তা লিখে না রাখলেও বড় কম নয়. ছোট ছেলে অনুজকে আই টি আই তে পড়াতে গিয়ে নিজের রিটায়ারমেন্ট বাবদ পাওয়া জমানো টাকায় হাত পড়েছে. আহত মাধব বাবু এও জানালেন, আমাদের চাকরি জীবনে সন্তোষজনক বেতন বৃদ্ধি হয়ে ছিল প্রায় দশ বছর পর. আর তুমি তো শুরুই করলে প্রায় কমবেশী পয়ঁত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে. এরপর প্রতি বছর ইনক্রিমেন্ট, মাস পয়লা বেতন আর কী চাই?
আমাদের চাকরি জীবনের শুরুতে শিক্ষক -শিক্ষিকারা মাস পয়লা বেতন পেতেন না. খোদ সরকারি কর্মীরা মাসপয়লা বেতন পেলেও প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারির শিক্ষকরা পাঁচ থেকে আট তারিখএর আগে বেতন পেতেন না. কোন কোন মাসে আরও দেরী হতো. ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যক্তিগত একাউন্টএ বেতন বাবদ টাকা দেওয়া অনেক পরে চালু হয়েছিল. এখন তো শুধু বেতন নয় পেনশনের মেসেজও তিন চার দিন আগেই চলে আসে.
অসীম বাবার মুখের ওপর কোন কথা না বললেও মনে মনে বিব্রত হলো. রাগ হলো বাবার ওপর.
বোনের বিয়ের খরচের ব্যাপারে নীরব রইলো. মায়ের কাছেও কোন অতিরিক্ত দায় নেবার বিষয়টি এড়িয়ে গেল.
নির্দিষ্ট দিনে সীমার বিয়েও হয়ে গেল.
অসীম বাবার হাতে রিসেপশন বাবদ যা খরচ হয়েছে তা দিয়েও দিল.বেকার ছোট ছেলে অনুজ তার জমানো টাকা থেকে কিছু সাহায্য করলো.
এতেও অসীমের চেতনা ফিরলো না.
মাধব বাবু বড় ছেলের এই নিস্পৃহতায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লেন. অতি যত্ন করা গাছের প্রথম ফল যদি টক হয় তাহলে বাবা -মার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়.
বড় ছেলে অসীম এতটা স্বার্থপর হয়ে যাবে তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি.
নিজের আস্থা ও বিবেকের কাছে নিজেই হেরে গেলেন.
এই ছায়াযুদ্ধের শেষ কোথায় কে জানে!
মা বন্দনা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনকে শান্ত করলেন.