
আজ সকাল থেকেই খুব লিখতে ইচ্ছে করছে। যারা একটি আধটু লেখেন তারা জানেন, লেখাটা পেট হাল্কা করার মত, যখন আসতে থাকে তখন প্রবল তার বেগ, সে সময় না লিখে ফেলতে পারলে হয়তোবা আর লেখাই হবে না।
কিন্তু বাড়ির বউ , বাচ্চার মা, চাইলেই কাগজ কলম নিয়ে বসে পরবে বা মোবাইল নিয়ে ততটা মর্ডান পরিবার আমার নয়। আর তাছাড়া বিছানা তোলা,রান্না, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, মেয়ে পড়ানো, ঘর মোছা, ভেজা জামাকাপড় মেলা, শুকনো জামাকাপড় তুলে আনা, খেতে দেওয়া, ঠাকুর পূজো এসবে হয়তো খাটনি নেই কিন্তু সময়টাতো লাগে। তাছাড়া একাজ আমার কে করে দেবে?
শাশুড়ি বয়স্কা, শীতে দাঁড়িয়ে একটু রোদ পোহাবেন না এইসব করবেন?তাকে বলতে বিবেকে বাধে। আরে আমার তো রোজ এখন স্কুল নেই।অন লাইন ক্লাস আছে,কিন্তু সে তো মোবাইলে বাড়িতে বসে।দিব্যি অন্য কাজ করতে করতে করা যায়।
কর্তা সকলে অবশ্য চা টা করে দিয়েছেন, ফিরবেন সেই সন্ধ্যা পার। ফ্লাস্কে আছে, ইচ্ছে হলে দু চার কাপ খাওয়াই যায়। যাক্ গে। সব সেরে উঠতে উঠতে লেখা মাথায় উঠে গেছে! আর বেলা ও তখন পড়ো পড়ো। সন্ধ্যা, মেয়েকে তো পড়তে বসাতে হবে।
এখন সময় বলতে সবাইকে খাইয়ে দিয়ে, সব বিছানায় গেলে তারপর। ধুত্তোর! পেন চিবিয়ে ও আঁতিপাঁতি খুঁজে সে লেখার আর টিকির নাগাল পেলাম না। গেল আমার এক রোমহর্ষক, মর্মান্তিক, মর্মন্তুদ লেখার সলিল, থুড়ি সংসার সমাধি।
এখন কাজের লোক রাখা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে গ্যাঁটের কড়ি খসবে আমারই। সেও না হয় হল, কিন্তু যতোবার ই লোক রেখেছি, আমি বেড়িয়ে গেলে বাড়ির লোকের সাথে খিটিমিটি তে তারা টেকেনি বা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তারা নাকি দূরে ভালো কাজ পেয়ে আমার বাড়ি ছেড়ে যায়। তারপর অবশ্য তাদের আমার পাড়াতেই কাজ করতে দেখি। কারণ আন্দাজ করতে পারলেও জিজ্ঞাসা করি না, ভয়ে। কি জানি বাবা, কেঁচো খুঁড়তে যদি কেউটে বেড়োয়।
রান্নার লোকের রান্না বাড়ির কারো না পসন্দ! রুটি কাঁচা, এঁটো সকড়ি মানে না, বাসি জামাকাপড়, না জানি কত বাড়ি ঘুরে আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর চাইলেই যে মনের মত, বা কাজ চালাবার মত লোক পাওয়া যায় না, এ ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে।
যাই হোক, শেষমেশ বিরক্ত হয়ে মা ফোন করায় বললাম দুঃখের কথা, “দেখো আর ভাল্লাগে না, এই রাজ্যের কাজ সেরে একটু লিখবো তার উপায় নেই। ধুর আজ আর রাঁধবো না। যেমন তেমন চালিয়ে নেবো”।
“না মা, তা বললে কি হয়? তুমি মা, তোমার সন্তান আছে। তার জন্য তো তোমায় ভাবতে হবে? “, মার অকাঠ্য যুক্তি।
“কিন্তু মা, তারজন্য এই ঊনকোটি চৌষট্টি সামলাতে আমি একটু লিখতে পারবো না, বল? রান্না তো সবাই পারে, কিন্তু লেখা? ভগবান যখন আমাকে এ আশীর্বাদ টা দিয়েছেন আমি একটু তা কাজে লাগাতে পারবো না? “, আমিও হাল ছাড়ার পাত্রী নই লড়ে যাচ্ছি প্রাণপণ।
” দেখো, সংসার ধর্ম মেয়েদের সবার আগে। সেটা সব থেকে আগে করতে হবে। বাকি কাজ পরে। আগে রান্না বান্না, জামাই, মেয়ের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে তারপর বাকি কাজ। এগুলো তুমি করবে না কে করবে? ” মা বোঝানোর ভঙ্গিতে সুর নরম, তুই থেকে তখন তুমি।
“কিন্তু এতো কি একা মানুষের পক্ষে সম্ভব? তাছাড়া সময়? সময় কি করে ম্যানেজ করবো? কেউ একটু বুঝবে না? “, আমি তখন মরীয়া।
মা মোক্ষম অস্ত্র ছাড়ে, ” দেখো, মেয়েরা মা দুর্গার জাত, দশ হাতে সব সামলাতে পারে, তুমিও পারবে, ” মোক্ষম অস্ত্রে আমার মা আমাকে হারিয়ে দিয়ে চলে গেলো আর আমি? একেবারে গো হারান হেরে গেলাম মায়ের কাছে।
এভাবেই আমার মা বোধহয় দিদার কাছ থেকে ভাবতে শিখেছে, কিন্তু আমি শিখিনি। তাই আমি এখোনো আকাশ খুঁজি। আমার মেয়েকেও শেখাবো জীবনের সত্যিকারের সার্থকতা ও যেটা মনে করবে সেটাই, আমার বা সমাজের চাপিয়ে দেওয়া ভাবনা নয়। আমি ওকে খোলা আকাশ দেখতে শেখাবো, তবে যদি ওর ভালো লাগে।