” সামনের এই রাস্তাটা দিয়ে মিনিট পাঁচেক হেঁটে গেলে দেখবেন একটা বড় বটগাছ আছে। অনেক পুরানো। সত্তর- আশি বছর তো হবেই। ওর পাশ দিয়ে একটা সরু গলি আছে। গলিটা যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে হয়ত আপনি যা চাইছেন পেতে পারেন।” কথাগুলো বলে চলে গেল লোকটা।
প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে একদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে সেদিক ঘুরছে ধীমান। সঙ্গী একটা সাইকেল। যাকে দেখছে তাকেই জিজ্ঞেস করছে। তারা যেদিকে বলছে সেদিকেই যাচ্ছে। কিন্তু পাচ্ছে না। তারা ভুল বলছে না, তবে ওর উদ্দেশ্যও সফল হচ্ছে না ।
ধীমানের একমাত্র মেয়ে ঐশী। আগামীকাল ওর সাত বছরের জন্মদিন। ঐশী ওর বাবার কাছে একটা উপহার চেয়েছে। হাতি- ঘোড়া কিছু নয়। কিন্তু ধীমানের এখন মনে হচ্ছে হাতি- ঘোড়া চাইলেই ভালো হত। তবু মনে হয় একটা ব্যবস্থা করা যেত।
ধীমানের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। একটা শাড়ির দোকানে হেল্পারের কাজ করে। লকডাউনে কাজ যায়নি ঠিকই, তবে মাইনে কমেছে। ছুটিও কমেছে। তবে এখন এই মুহূর্তে এই চাকরিটা ছেড়ে অন্য কিছু করবে সেই সম্বলও ওর কাছে নেই। অগত্যা তাই চালিয়ে যাচ্ছে।
ঐশীর বয়স সাত হলে কি হবে , ও বাবার অবস্থা বোঝে। তাই এবার ও পুতুল চায়নি, দম দেওয়া গাড়ি চায়নি, এমনকি বড় পেস্ট্রিও চায়নি। শুধু চেয়েছে একটা দোলনা। ঘরে কিনে আনতে বলেনি। ঐশী জানে ওর বাবার দোলনা কেনার টাকা নেই। যদি বা ওর বাবা কিনে আনেও, ওদের ছোট্ট ঘরে , যেখানে ওরা তিনজন খুব কষ্ট করে থাকে, বৃষ্টির দিনে ঘরের যেটুকু জায়গায় জল পড়ে না, সেখানে ওরা তিনজন গুটিশুটি মেরে বসে থাকে, আর বৃষ্টি থামার প্রার্থনা করে, সেই ঘরে দোলনা রাখা যাবে না ।
গতমাসে ঐশীর পাড়ার বান্ধবী এনাকে ওর বাবা- মা জন্মদিনে ইকোপার্ক, নিকোপার্ক বেড়াতে নিয়ে গেছিল। এনা ওখানে অনেক রকম রাইড চড়েছে। ঐশীকে গল্প করেছে এনা। ফটো- ভিডিও সব দেখিয়েছে ওর মায়ের স্মার্টফোন এনে।
ঐশী জানে ওর বাবার এত টাকা নেই যে ওইসব পার্কে নিয়ে যাবে। তাই ও বাবাকে বলেছে, সাইকেলে চড়ে যাওয়া যায় এমন পার্কে নিয়ে যেতে, যেখানে দোলনা আছে। মনের সুখে ও দোলনা চড়বে।
সকাল থেকে সেই রকম পার্কই খুঁজে চলেছে ধীমান।
অনেক পার্কই এখন আর নেই। সেগুলো সব ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। যেগুলো আছে , সেগুলোতে হয় দোলনা নেই, আর দোলনা থাকলেও ঢোকার জো নেই। কোনটায় মেলা, কোনটায় খেলা, কোনটায় আবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল বাঁধা।
দিনের শেষে হতাশ হয়ে বাড়ির পথে সাইকেল ঘোরায় ধীমান। মনে মনে ভাবে, এতদিন ঐশী জানত ওর বাবার টাকা নেই। আজ থেকে ও জানবে এ শহরটার কোনো মন নেই। এতকিছু থাকা সত্ত্বেও তাই তো শহরটা মনমরা হয়ে বাঁচে।