পরম শ্রদ্ধাবতী চিরনমস্যা
মা, এখানে রাতের আকাশ আর দিনের আকাশ যেন সমানতালে ঘণঘোর মেঘাচ্ছন্ন। তারাহীন নিঃসীম ঘণ দুপুরে কিংবা বিভিন্ন মাপের অমাবস্যায় রাতের তারারাও কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। কে বা কারা যেন ছায়াহীন অনন্ত যুদ্ধে লিপ্ত। কেন? নিবৃত্তি নেই! অসংখ্য বাঁশঝাড়ের প্রাবল্য সত্ত্বেও বিরাট বিস্তীর্ন নিস্তব্ধতা– কোনও ব্যস্ততা নেই। নৈঃশব্দের শূন্যতায় মানুষের দিবাস্বপ্ন সহজ ছন্দকে, স্বাভাবিকতাকে হার মানিয়ে হতাশার প্রহর গুনছে। কেন- কেন- কেন মা!!?
তাই, কিছু নিরীহ সময়ের মাঝে আমি তোমাকে স্মরণ করছি মা আজ এই মুহূর্তে।
জন্ম জন্মের তুমি যে আমার মা– গর্ভধারণী না হয়েও মা ধরিত্রী বসুন্ধরা আমার জন্মভূমি, আমার পিতৃভূমি; আমার ইহকাল, পরকাল। ” সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে/ সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে “। তবু– তুমি আমার নয়ন সমুখে নাই। তোমার স্নেহ, পেলবতা, মধুর হাসি, বৃষ্টির ছাঁট, গ্রীষ্মের দহন, শারদীয়ার উৎফুল্লতা, শীতের রুক্ষতা আর নব কিশলয় যেন লালচে হয়ে গেছে। প্রান্তর ঘিরে শুধু অশান্তির নির্ভেজাল কোলাহল।
গ্রাম থেকে শহর হচ্ছে। গাছে গাছে দুলছে নানান দৈর্ঘ্যের রঙীন বাল্ব, কোথাও বা নিয়ণ, আবার মযদান হয়েছে শিশুউদ্যান নয়তো নারী পুরুষের জমজমাট প্রেমালাপ এর তীর্থক্ষেত্র। জোনাকিরা উধাও। ভূত প্রেত শাঁখচুন্নিরা আর ভয় দেখায় না। ভয় পাই বোমা পিস্তল আর দাদাগিরিতে। শান্তি এখনও বারান্দায় রোদ্দুর দেখেও তোমার দেখা পায়না। তুমি কোথায় মা?
আবার ধরো গো অসি/ কেটে যাক অনন্ত মসি /মানিয়া সভ্যতার রং।
তোমার যে কথামৃত শুনে আমি নিদ্রাসক্ত হ’তাম সেটা আবার প্রয়োগ কর। সমস্বরে যেন গেয়ে উঠি– বাংলা আমার মা/ আমরা তোমারই সন্তান। / হাসি কাঁদি কথা বলি/ বাংলাতেই গাই গান।
মাগো, বৈকুণ্ঠেও তোমার ডাক এসেছে শুনলাম। ভালো। গর্ব হচ্ছে শুনে জেনে। তোমার গায়ের রং ঈষৎ কালী বর্ণ হলেও তুমি সুনয়না সুকেশীনী, রত্নগর্ভা। গঙ্গা তোমার জন্য বিনম্র হৃদয়ে প্রদক্ষিণ ক’রে চলেছে অহরহ। এটা আমাদের গর্ব।
তোমার সুশীতল স্পর্শে আমরা শিহরিত, চমকিত। এই যক্ষপুরীতেও আমরা বীরদর্পে প্রতিবাদ করতে জানি। “মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি”।
শুনেছি, বিদেশি শত্রুরাও ওঁৎপেতে অপেক্ষা করছে। আমরাও চুপ করে বসে নেই। তোমার কোনও ক্ষতি আমরা হতে দেব না। মেনে নেবো না সামান্যতম অপমানও: আমরা এখন আর ত্রিংশতি কোটি নরনারী নই। — এখন আমরা একশত তিরিশ কোটি। ধর্মযুদ্ধ হলে তোমার সম্মানে আবার গান্ডীব তুলে নেব। গীতাকে প্রাধান্য দিয়ে কৃষ্ণকে সারথি করবো। জয় আমাদের হবেই। লম্ফঝম্ফ করে গুম্ফ প্রদর্শন করে কেউ পার পাবে না আর।
তুমি আমাদের প্রেরণা- আমাদের সাহস- আমাদের সঞ্চয়- আমাদের শক্তি। তোমাকে সাষ্টাঙ্গে হাজারো প্রণাম জানাই।
তুমি আশীর্বাদ করো। যেখানেই থাক সুখে থাক– জেনো আমরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বিবেকানন্দদের পেয়েছি। পেয়েছি শ্রীকৃষ্ণ শ্রীচৈতন্যকেও। বিদ্রোহী মাতঙ্গিনী হাজরাকে পেয়েছি। পেয়েছি অসীম সাহসী ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ, বালক ক্ষুদিরাম, নেতাজি এবং বালগঙ্গাধর তিলক ও বিনয় বাদল দীনেশ কে। পেয়েছি বিদ্যাপতি, চন্ডী দাস, রামপ্রসাদকেও। সবই তোমার দান।
তাই প্রতি ধ্বনি করতে ইচ্ছা জাগে–” ও আমার দেশের মাটি তোমার প’রে ঠেকাই মাথা “!
হাজার কষ্টের মধ্যেও শান্তি পাই তোমার কথা ভেবে। তোমার মতো মা যেন জন্মজন্মান্তরেও পাই। শেষ করতে ইচ্ছা হচ্ছে না।
তবুও— এবং প্রণতঃ
ইতি
আশীর্বাদ প্রার্থী তোমার এক
হতদরিদ্র সন্তান।
সত্যেন্দ্রনাথ পাইন।
২৬ আষাঢ় ১৪২৫
পশ্চিম বঙ্গ
ভারত।